২০২০ সালকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুজিব শতবর্ষ হিসেবে পালন করবে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়’-এর পক্ষ থেকেও বছরব্যাপী বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করা হবে।১৯২০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলার স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ লুত্ফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের কোল আলোকিত করেছিলেন বাংলার আকাশের ঊজ্জ্বল নক্ষত্র, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশ্বনন্দিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যথার্থই বলেছিলেন, ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।/দিকে দিকে আজ অশ্রুমালা রক্তগঙ্গা বহমান/তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।’ প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু আমাদের অনুভূতি ও অন্তর আত্মায় মিশে আছেন। শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ। শেখ মুজিব মানেই স্বাধীন বাংলাদেশ। জাতির পিতার প্রতি আমাদের ঋণ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা অশেষ। শেখ মুজিব মানেই বাংলার মুক্ত আকাশ। শেখ মুজিব মানেই বাঙালির অবিরাম মুক্তির সংগ্রাম।
আমি বিশ্বাস করি, আসছে ১৭ মার্চ হলো বাংলার স্বাধীন রক্তিম সূর্যের উদয়। বঙ্গবন্ধুই বাঙালির স্বাধীনতার মহানায়ক। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার জন্ম না হলে বিশ্বের মানচিত্রে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেতাম না। বঙ্গবন্ধু স্কুলজীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে তিনি কারাবরণ করেন। হাজার হাজার ঘটনার মাঝে ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিরাজগঞ্জে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কয়েকটি লাইন উল্লেখ না করে পারছি না। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘শাসনতন্ত্রে লিখে দিয়েছি যে কোনো দিন আর শোষকেরা বাংলার মানুষকে শোষণ করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।’ ‘আমি বাঙালি। বাঙালি জাতি হিসেবে বাঁচতে চাই সম্মানের সঙ্গে। আমার রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ। মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে, হিন্দু তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে, বুদ্ধিষ্ট তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। তবে একটা কথা হলো, ধর্মের নামে আর ব্যবসা করা যাবে না।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, শোষণমুক্ত ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়াটাও ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয়। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৮ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর আজো শোষণমুক্ত ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়া বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয়ই রয়ে গেছে।
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের ‘আপনার সবচেয়ে বড়ো যোগ্যতা কী’ এই প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি।’ ডেভিড ফ্রস্টের ‘আপনার বড়ো দুর্বলতাটা কী’ এই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশের মানুষকে বেশি ভালোবাসি।’ এ কথার মাধ্যমে জনগণের প্রতি জাতির পিতার অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের প্রতি বিশ্বাসের বিষয়টিও সুস্পষ্ট। দেশকে ভালোবাসতে হবে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে—এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের অন্যতম দর্শন। তিনি শুধু জনগণকে ভালোই বাসতেন না, বাংলার জনগণকে নিয়ে তিনি গর্ববোধও করতেন। সে কারণেই ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভাষণে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে কবিগুরুর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কবিগুরুর আক্ষেপ আমরা মোচন করেছি। বাঙালি জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে। এমন কাজ তারা এবার করেছে, যার নজির ইতিহাসে নাই। হে কবিগুরু, আপনি এসে দেখে যান, আমার ৭ কোটি বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণের দিন বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি সব ত্যাগ করতে পারি, তোমাদের ভালোবাসা ত্যাগ করতে পারব না।’
বঙ্গবন্ধু আমাদের অসীম সাহসীকতার প্রতীক। তিনি সমগ্র বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, তিতুমীর, সুভাষ বোস, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জগদীশচন্দ্র বসু, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর মতো সাহসী নেতৃত্বের নির্যাস তিনি নিজের মধ্যে ধারণ করতেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন গরিব-দুঃখীসহ সমগ্র বাঙালির সত্যিকারের মহান বীরপুরুষ। অধিকার আদায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে বহুবার তিনি জেল খেটেছেন। তার জীবনের ১৪টি বছর জেলের মধ্যেই কেটে গেছে। জাতির পিতা তার রাজনৈতিক জীবনে প্রায় ৫ হাজার দিন কারাভোগ করেছেন। কিন্তু মানুষের অধিকার ও দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে এবং দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে কখনোই পিছু হটা তো দূরের কথা, বিন্দুমাত্র ভয়ও পাননি। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় নির্জন সেলের সামনে কবর খুঁড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অসীম সাহসী বাঙালির নেতা শেখ মুজিব ভয় পাননি, বরং পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে বলেছেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মুসলমান, আমি মানুষ। মানুষ একবার মরে, বারবার মরে না। আমি কখনোই আত্মসমর্পণ করব না। যদি তোমরা আমাকে মেরে ফেল, মৃত্যুর পর আমার লাশটা আমার দেশে আমার মানুষদের কাছে পৌঁছাইয়া দিও।’
আবারও জোর দিয়ে বলতে চাই, ঘাতকেরা হয়নি সফল; মুজিব চেতনায় জাগ্রত, হূদয়ে স্পন্দিত, শোকাহত-প্রতিবাদী-মুজিব বিপ্লবী জনতা কোটি কোটি। মুজিব মরেনি; মরতে পারে না; শতবর্ষে শেখ মুজিব শতকোটি গুণ শক্তিশালী। প্রকৃতপক্ষে ঘাতকেরা বুঝতে পারেনি, বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। বঙ্গবন্ধুকে সব সময়ই স্মরণ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু বাংলার বন্ধু, মানুষের বন্ধু, বিশ্ববন্ধু। বঙ্গবন্ধু আমাদের রক্তঋণে আবদ্ধ করে গেছেন। মুজিব শতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা, আদর্শ, নীতি, জীবন, শিক্ষা ও চিন্তা আমাদের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। মুজিব আদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি কথা উল্লেখ করতে চাই। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে চাইলে সোনার মানুষের দরকার। তাহলেই সোনার বাংলা গড়তে পারব।’ বঙ্গবন্ধু আরো বলেছিলেন, ‘ভাইয়েরা বোনেরা আমার, দেশে একদল লোক সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। জীবনভর আমি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। স্বাধীতার জন্য এদেশের মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। রক্ত দিয়েছে একটা আদর্শের জন্য। জাতীয়তাবাদ, যা তোমরা বিশ্বাস কর, এটা হলো আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা, বাংলার ইতিহাস, বাংলার মাটি, বাংলার আকাশ, বাংলার আবহাওয়া, তাই নিয়ে বাংলার জাতীয়তাবাদ। আমি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তা তোমরাও কর। শোষণহীন সমাজ, সুষম বণ্টন, সম্পদের মালিক জনগণ—তোমরা তা বিশ্বাস কর। এই লক্ষ্যে পৌঁছবার কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। আস্তে আস্তে যেতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর এই কথার প্রয়োজনীয়তা ২০২০ সাল, অর্থাত্ মুজিব শতবর্ষে আরো বেশি প্রযোজ্য। তাহলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে আমাদের সবাইকেই সোনার মানুষ হতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। আমি আরো মনে করি, মুজিব শতবর্ষ হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে মুজিব আদর্শ বাস্তবায়নের বছর। কারণ দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, ভাগ্য পরিবর্তনের নির্মাতা, দেশের উন্নয়নের রূপকার, বাংলার আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র, মাদার অব হিউম্যানিটি, বিশ্বনন্দিত নেতা, দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার মাধ্যমেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়া ও মুজিব আদর্শ বাস্তবায়ন সম্ভব। সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়ন, এসডিজি অর্জনে আইসিটি ব্যবহারে প্রচারণা, ডিজিটাল ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অগ্রগতি ও শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রাখা, বিশ্ব মহিলা ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়নে অনন্য অবদানের জন্য গ্লোবাল উইমেন্স লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড, আইসিটি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, গ্লোবাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড, এজেন্ট অব চেঞ্চ পুরস্কার ও প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন, জাতিসংঘের সাউথ সাউথ কো-অপারেশন ভিশনারি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ সাউথ পুরস্কার, সম্প্রতি ভ্যাকসিন হিরো, চ্যাম্পিয়ন অব স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর ইয়ুথ পুরস্কার, অতি সম্প্রতি মর্যাদাপূর্ণ এশিয়ান টাউনস্কেপ জুরিস অ্যাওয়ার্ডসহ ৩৯টিরও বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কার/অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন। ফোবর্সের প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় স্থান করে নেন। পরিশেষে এ কথা সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করতে চাই, জাতির পিতার জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। অর্থাত্ সমগ্র বাঙালি জাতি একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার সুযোগ পেত না। জাতির পিতা আমাদের শিখিয়ে গেছেন, কীভাবে ঝড় ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথে মাথা উঁচু করে সামনের দিকে এগিয়ে চলতে হয়, অধিকার আদায় করে নিতে হয়, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়। আমাদের চলার পথ কখনোই মসৃণ নয়। মুজিব জন্মশতবর্ষে আমাদের শপথ হোক—বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র—সংবিধানের এই চার মূলনীতিকে সত্যিকার অর্থেই প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধভাবে আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
লেখক :অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া, উপাচার্য,
সূত্রে,ইত্তেফাক