বঙ্গোপসাগর এবং এর কাছাকাছি এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি ঘনীভূত হয়ে একই এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এ পরিণত হয়েছে। বুধবার দুপুর নাগাদ ভারতে আছড়ে পড়তে পারে ঘূর্ণিঝড়টি। সেই সময় ঘণ্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার বেগে বইবে ঝড়। কখনও কখনও ঝড়ের বেগ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। এদিকে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব বঙ্গোপসাগর উপকূলে পড়তে শুরু করেছে। জোয়ারের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে পানি। উত্তাল হয়ে উঠেছে সমুদ্র উপকূল।
তবে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ থেকে বাংলাদেশ অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শামসুদ্দিন আহমেদ। তবুও উপকূলীয় অঞ্চলে নেয়া হচ্ছে ব্যাপক প্রস্তুতি। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার উপকূলবর্তী মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সেইসঙ্গে উপকূলের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান বন্ধ করা হচ্ছে। বন্ধ হচ্ছে হোটেল-মোটেলগুলোও। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে উপকূলীয় জেলাগুলোর সর্বশেষ অবস্থা:
পটুয়াখালী
ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ প্রভাবে পটুয়াখালীর কলাপাড়া সৈকত সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর উত্তাল হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুট সমুদ্র ও নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সাগরের পাড়ে বসবাসরত অস্থায়ী বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ১৬৭টি আশ্রয়কেন্দ্র, নবনির্মিত ২টি মুজিব কিল্লা ও ১৫টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এছাড়া ইয়াস মোকাবেলায় কুয়াকাটার অর্ধশত হোটেল-মোটেলকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের উদ্দোগ নিয়েছে হোটেল মোটাল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সিপিপি, রেড ক্রিসেন্ট, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সসহ ফায়ার সার্ভিসের কমিউনিটি ভলান্টিয়ার টিমের সদস্যরা প্রস্ততি নিয়েছে।
আরও পড়ুন: ভোলা উপকূলের ৩ লক্ষাধিক মানুষকে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি
সোমবার বেলা ১২টায় উপকূল সংলগ্ন উপজেলা কলাপাড়া প্রশাসনের দরবার হলে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় প্রস্তুতিসভা করেছে প্রশাসন। সভায় ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানায় প্রশাসন। ৪৮ কি.মি. এর মধ্যে প্রতি ঘণ্টায় এর গতিবেগ ৬২-৮৮ কি.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পায়রা বন্দরকে দুই নম্বর সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
কক্সবাজার
কক্সবাজার সৈকতে লোকসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং হোটেল-মোটেল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। রোববার রাতে জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির ভার্চ্যুয়াল সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
কক্সবাজারের ট্যুরিস্ট পুলিশ সুপার (এসপি) মো. জিললুর রহমান বলেন, করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সৈকতে পর্যটকসহ লোকসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই সময়ে সৈকতে যেন কেউ নামতে না পারেন, সে জন্য পুলিশের পাহারা বসানো আছে। এছাড়া বিনোদন কেন্দ্রগুলোও বন্ধ আছে।
চট্টগ্রাম
ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় ইতোমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। রোববার বিকেলে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় প্রশাসনের প্রস্তুতির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় চট্টগ্রামে জেলা ও উপজেলায় প্রস্তুত করা হয়েছে ৫০০টি আশ্রয়কেন্দ্র। ৫ জন এডিসি উপকূলবর্তী উপজেলাগুলোর আশ্রয় কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করেছেন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ বাংলাদেশে ২৫ বা ২৬ তারিখে আঘাত হানতে পারে। এজন্য ১ নম্বর দূরবর্তী বিপদ সংকেত জারি করা হয়েছে। জেলার আওতাধীন প্রতিটি উপজেলা প্রশাসনকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। চলছে সচেতনতামূলক মাইকিং।
উপকূলবর্তী সকল উপজেলার ইউএনও, এসিল্যান্ড,থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্ত (ওসি), পিআইও ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে থাকার জন্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। করোনার কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার কারণে দীর্ঘদিন ধরে অপরিষ্কার ও জরাজীর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বিদ্যুৎ সংযোগ ও অন্যান্য ভৌত অবকাঠামো প্রস্তুত করার জন্যে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এছাড়া যে কোনো সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি ও আশ্রয়কেন্দ্রে আনয়ন, সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ এনজিওসমূহ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পর্যাপ্ত ত্রাণ ও খাদ্যসামগ্রী মজুদ রাখা হয়েছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে। গোখাদ্য কেনার জন্যে প্রতিটি উপজেলায় ১ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে প্রচার প্রচারণাসহ মাইকিং করা হচ্ছে।
বরিশাল
ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর ভয়াবহতা থেকে উপকূলের মানুষের জানমাল রক্ষায় বরিশাল জেলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৩১৬টি সাইক্লোন শেল্টার এবং ৭৫৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এজন্য রোববার বরিশালের সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে জুম কনফারেন্স করেছেন জেলা প্রশাসক। সভায় ঘূর্ণিঝড় শুরুর আগেই সকল এলাকায় সতর্ককতামূলক মাইকিং করার নির্দেশনা দেয়া হয়।
এছাড়া ঘূর্ণিঝড় শুরুর আগেই সাইক্লোন শেল্টারসহ আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গৃহপালিত পশুসহ সকলকে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেন জেলা প্রশাসক।
বরিশাল জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার সুব্রত বিশ্বাস দাস বলেন, বরিশাল জেলায় মোট ৩১৬টি বিশেষায়িত সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে। এছাড়া দুর্যোগকালীন সময়ে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের মতো জেলায় ৭৫৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাকা ভবন রয়েছে। সাইক্লোন শেল্টার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৬ লাখ ৪২ হাজার মানুষ এবং প্রায় ৫০ হাজার গবাদিপশু নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারবে। ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য আঘাত হানার খবরে ওইসব সাইক্লোন শেল্টার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাথরুম-টয়লেট ব্যবহার উপযোগী এবং সুপেয় পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা, বিদ্যুত না থাকলে বিকল্প ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এছাড়া শুকনা খাবারেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এচজাড়া ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে স্থানীয় জনগণের মাঝে বিতরণের জন্য জেলায় ৮৪ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১৫ লাখ টাকা রয়েছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক মন্ত্রণালয়ে যোগযোগ করা হচ্ছে। সরকারের যে কোনো নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে।
ভোলা
ভোলায় উপকূলের ৩ লাখ ১৮ হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রসাসন। জেলার সাত উপজেলার ৪০টি দ্বীপচরকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে আনার এ প্রস্তুতি নেয়া হয়। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এসব তথ্য জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক তৌফিক-ই-লাহী চৌধুরী। রোববার বিকালে জেলা প্রশাসন সম্মেলন কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় জেলা প্রশাসক জানান, ঝড় মোকাবেলায় জেলার ৭০৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে ৭৬টি মেডিকেল টিম। অন্যদিকে সিপিপি’র ১৩ হাজার সেচ্চাসেবী ছাড়াও রেডক্রিসেন্ট এবং স্কাউটসকর্মীদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খোলা হয়েছে ৮টি কন্ট্রোল রুম। ঘূর্ণিঝড়ে যাতে উপকূলীয় জেলা ভোলাতে ক্ষয়-ক্ষতি কম হয়, সে লক্ষ্যে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সবাইকে সাহসিকতার সাথে ঝড় মোকাবেলার আহ্বান জানিয়ে ভোলার জেলা প্রশাসক বলেন, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সকল কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্বাস্থ্যবিভাগসহ জেলা প্রসাসনের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের কর্মকর্তা এবং মাঠ পর্যায়ের আনসার-ভিডিপি সদস্যসহ সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। এছাড়াও প্রতিবন্ধী, নারী ও শিশুদের নিরাপত্তায়ও আলাদা টিম গঠন করা হবে। প্রস্তুত থাকবে ফায়ার সার্ভিসের ১৪ টিম ও স্বাস্থ্যবিভাগের ২০০ কমিউনিটি ক্লিনিক।
সাতক্ষীরা
ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ মোকাবলায় উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমটিরি জরুরি সভাও অনুষ্ঠিত হয়ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ সাতক্ষীরা-খুলনা উপকূলে ২৬ মে আঘাত হানতে পারে। এ ধরণের পূর্বাভাস দেখেই ইতিমধ্যে সকল ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়ছে।
জেলার ১৪৫টি আশ্রয়কেন্দ্র ও ১৫০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রাখা হয়ছে। এছাড়া ১৮৩ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে দুই কোটি ১৫ লাখ টাকার নগদ অর্থ রাখা হয়েছে সহায়তার জন্য। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলটে ও ওয়াটার ট্যাংকি প্রস্তুত রয়েছে। শ্যামনগর ও আশাশুনিতে ৪ হাজার ৮৮০ জন স্বেচ্ছাসেবেক প্রস্তুত রাখা হয়ছে। এছাড়া পর্যাপ্ত সহায়তায় পরিমাণ প্রস্তুত রয়েছে পুলিশ, আনসার, বিজিবি ও স্বাস্থ্য বিভাগের সদস্যরা।