দেশের বিভিন্ন হাওর-বাঁওড় থেকে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কমে আসছে দেশীয় মাছের সংখ্যাও। মাছের আশ্রয়স্থল, প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র শিল্পায়ন, নগরায়ন, কৃষিজমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছ হুমকির মুখে পড়েছে।এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এসব মাছ হারিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে নষ্ট হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্যও, বলছেন গবেষকরা।
এদিকে প্রজনন মৌসুমে অবাধে মাছ শিকারের ফলে অসংখ্য প্রজাতির দেশীয় মাছ বিলুপ্তির পথে। কিন্তু বিলুপ্ত প্রজাতির দেশীয় মাছের উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিস্তার, জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং মৎস্যজীবীদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে সরকার।এজন্য দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ রক্ষায় প্রজননকাল নির্ধারণ করে ওই সময় মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধকাল আরোপ হতে পারে বলে জানিয়েছেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব রওনক মাহমুদ।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, দেশের মৎস্য উৎপাদনে দেশীয় ছোট মাছের অবদান ৩০-৩৫ শতাংশ। এ মাছের চাষাবাদ বৃদ্ধি বাড়ায় বর্তমানে হ্যাচারিতে পোনা ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। পোনাপ্রাপ্তি সহজ হওয়ায় বর্তমানে মাঠপর্যায়ে পাবদা, গুলশা, শিং, টেংরা, মাগুর ও কৈ মাছ ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। বর্তমানে দেশীয় মাছ উৎপাদন হচ্ছে ৩ লাখ ৮৩ হাজার টন। পাবদা, গুলশা, গুজি আইড়, রাজপুঁটি, চিতল, মেনি, ট্যাংরা, ফলি, বালাচাটা, শিং, মহাশোল, গুতুম, মাগুর, বৈড়ালী, ভাগনা, কুচিয়া, খলিশা, কালবাউশ, কই, বাটা, গজার, সরপুঁটি ও গনিয়াÑ এই ২৩ প্রজাতির মাছ আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
দেশের দক্ষিণ ও মধ্যপশ্চিম অঞ্চলের খাল-বিল, প্লাবনভূমি, নদী ও বাঁওড় সমৃদ্ধ অঞ্চল, যেখানে অধিকাংশ জলাশয়ে বছরের চার থেকে আট মাস পর্যন্ত এবং কিছু জলাশয়ে সারা বছর পানি থাকে। এসব এলাকায় দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তার ও বৃদ্ধির উপযোগী পরিবেশ থাকায় এক সময় দেশি কৈ, শিং, মাগুর, শোল, টাকি, রয়না, সরপুঁটি এবং টেংরা ও বাইনসহ আরও অনেক ধরনের মাছে ভরপুর ছিল।
কিন্তু খাল-বিল, নদী নালা ভরাট, বেশি হারে মাছ ও শামুক ধরা, কীটনাশক ব্যবহার, অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশীয় মাছ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমিষের চাহিদা বাড়ছে। ফলে বর্তমান সরকার দেশীয় মাছ সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা করেছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মিঠাপানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। মিঠাপানির ২৬০ প্রজাতির মধ্যে ১৪৩ প্রজাতি হচ্ছে ছোট মাছ।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মৎস্য ভবনে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) আয়োজিত ‘বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্পন্ন দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের প্রজননকাল নির্ধারণ ও সংরক্ষণ’ শীর্ষক এক কর্মশালায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব রওনক মাহমুদ বলেন, দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ সংরক্ষণে প্রজনন সময় নির্ধারণ করে সেসময় নিষিদ্ধকাল আরোপ করা হবে।
তবে নিষিদ্ধকাল হবে স্বল্প সময়ের জন্য। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কম সময় মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পেতে হবে। এজন্য একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হবে। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনে উপজেলাভিত্তিক পাইলটিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ সংরক্ষণে সম্মিলিতভাবে কাজ করার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে জনসম্পৃক্ততাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, দেশের মৎস্য খাতের প্রবৃদ্ধি অভাবনীয়। যে কয়টি বিষয়ে সফলতা ও গর্বের কথা বলা হয় মৎস্য খাত এর মধ্যে অন্যতম। জলাশয় কমে যাওয়াসহ নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বর্তমানে দেশে মাছের উৎপাদন প্রায় ৪৬ লাখ মেট্রিক টন।
মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক কাজী শামস্ আফরোজ বলেন, দেশীয় মাছের প্রজননকাল নিয়ে মৎস্য অধিদফতর কাজ করছে। দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে নতুন প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তা ছাড়া জনগণকে সচেতন করতে মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি মাছের অভয়াশ্রম সংরক্ষণ ও বিএফআরআই উদ্ভাবিত মাছের চাষ প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য মৎস্য অধিদফতর কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। এজন্য স্থায়ীভাবে মা-মাছ সংরক্ষণে বছরব্যাপী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে প্রজননকাল নির্ধারণ করে সাফল্য আসবে না।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ‘গবেষণার ফলাফল মাঠে সম্প্রসারণ করা না গেলে গবেষণার কোনো মূল্যই নেই। এজন্য বিএফআরআই’র সব গবেষণায় মৎস্য অধিদফতরকে সম্পৃক্ত করা হবে। তা ছাড়া জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে কোনো গবেষণায় সাফল্য পাওয়া যাবে না।