মানুষের জীবন আসলে কী? মানুষ কি বর্তমানে বাঁচে, ভবিষ্যতের প্রণোদনা ইঞ্জিন হয়ে তাকে সামনে টানে, নাকি তার অতীত, যাপিত সময়টাই তার জীবন? শেষেরটা যদি সত্য হয়, তাহলে জীবন মানে হলো জীবনযাপনের স্মৃতি। যতটা আমি মনে রাখতে পারি, ততটাই আমার জীবন। স্মৃতি সতত সুখের। আর আমাদের মধুরতম সংগীত তো সেসবই, যা আমাদের বিষণ্নতম কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়।
ফুটবল হলো আমাদের নস্টালজিয়ার দরজার চাবিকাঠি। ছোটবেলায় ফুটবল আমরা কে খেলিনি? আর কী দিয়ে ফুটবল খেলিনি? একটা দেশলাইয়ের বাক্স, একটা কাঠের টুকরা, কাপড়ের পুটলি, শুকনো কচুরিপানার দলা, জাম্বুরা—কী না আমাদের পায়ে ফুটবল হয়েছে! কোথায় আমরা ফুটবল খেলিনি? স্কুলের বারান্দায়, ক্লাসরুমে, মাঠে, পুকুরে, ধানখেতে, উঠানে, বাড়ির পেছনে, বাড়ির ছাদে— কোথায় নয়! ফুটবল তাই আমাদের শৈশবে নিয়ে যায়!
শুধু কি খেলা? ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা নাম উঠলেই তো স্মৃতির হাট বসে যায়! সেই যে একেকটা সাদা-কালো টেলিভিশন! বিশ্বকাপ দেখানো শুরু করল বিটিভি। রাত জেগে জেগে একেকটা ম্যাচ দেখা। আমাদের বয়সী মানুষেরা কী করে ভুলবে পাওলো রসির ঢোলা প্যান্ট, রবার্তো বাজ্জোর মাথার পেছনের টিকি। আহা, সেই বিশ্বকাপ ফাইনালে তাঁর সেই পেনাল্টি মিস করা ব্রাজিলের বিপক্ষে।
নেটফ্লিক্সে আ ডিভাইন পনিটেল ছবিটা দেখলাম, খুব মন খারাপ হলো, সেদিন অন্ধ ব্রাজিল সমর্থক হিসেবে বাজ্জোর পেনাল্টি মিস করার পর কী রকম উল্লাস করেছিলাম! আজ বাজ্জোর ওপর বানানো প্রামাণ্য ছবিতে তাঁকে পেনাল্টি মিস করতে দেখে কী রকম বিষাদ অনুভব করছি। ছবিটার একটা মেসেজ আছে বোধ হয়—গন্তব্য নয়, পথই মোকাম। আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ। খেলাটাই আসল, জয় নয়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করো, পথের শেষ কোথায়? শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে?
বাংলাদেশের সমর্থকদের বেশির ভাগই মনে হয় আকাশি-সাদাদেরই সমর্থন করে। সেটা হয়ে আসছে সেই ম্যারাডোনার আমল থেকে। হবেই বা না কেন! ইংল্যান্ডের সঙ্গে আর্জেন্টিনার যুদ্ধ বেধে গেছে ফকল্যান্ড দ্বীপ নিয়ে। সেই উত্তেজনার মধ্যে মধ্যমাঠ থেকে বল নিয়ে ম্যারাডোনা ছুটছেন। সব বাধা পেরিয়ে, একের পর এক খেলোয়াড় কাটিয়ে একেবারে নিশানায়। গোল। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় চিরদিনের জন্যে কিনে নিল আর্জেন্টিনা।
আর আছে ব্রাজিল। পাঠ্যপুস্তকে পেলের জীবনী পড়তে হচ্ছে—ব্রাজিলের কালো মানিক। সত্তরের আগের পেলের জাদুকরি খেলা সরাসরি কজনই বা দেখেছে বাংলাদেশের? কটা টেলিভিশনই বা ছিল দেশে! সত্তরের আগে জন্মানো মানুষই বা আছেন কজন! কিন্তু সক্রেটিসের আমলের ব্রাজিল, রোমারিওর ব্রাজিলও আমাদের স্মৃতির সলতে উসকে দেয়।
আজকালকার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বললে তারা হাসে। শোনো, তোমার ব্রাজিল ২০০২ সালের পর আর বিশ্বকাপ জেতেনি। ১৯ বছর হয়ে গেল। আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতেছিল সেই ১৯৮৬ সালে। সেদিন যাঁর জন্ম হয়েছিল, আজ তাঁর বয়স ৩৫। তবুও বাংলার মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত, আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল।
আমিও নেইমারের মতো খুব করে চাইছিলাম যেন আর্জেন্টিনা–ব্রাজিল ফাইনাল হয় কোপায়। এমনিতেই করোনায় আমাদের অবস্থা করুণ। ফুটবল যদি এ সময় একটু করুণাধারা বইয়ে দিতে পারে! তার ওপর ইউরো আর কোপা একই সময়ে হওয়ায় রাতের বেলা ইউরোপের দুটো ম্যাচ দেখে সকালবেলা ঘুম ঘুম চোখে কোপা দেখতে গিয়ে মনে হলো, এ যে গরিবের বাড়িতে নেমন্তন্ন।
মাঠের অবস্থা খারাপ, গ্যালারিতে দর্শক নেই আর ইউরোর সেই গতিই বা কোথায়! তার মধ্যে যদি ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার খেলাটাই ফাইনাল না হয়, তাহলে তো চার্মই থাকে না।
ফুটবলের সঙ্গে স্মৃতি জড়িত বলছিলাম। আমার মেয়েটা যখন ছোট ছিল, তখন তাকে ব্রাজিলের সমর্থক বানিয়েছিলাম। ২০০২ সালে ব্রাজিলের জার্সি পরে সাত বছর বয়সী মেয়ে আমার সঙ্গে বসে ফাইনাল বিশ্বকাপ দেখেছিল। ২০১০ সালে এসে মেয়ে বিদ্রোহ করল, ‘বাবা, আমি আর ব্রাজিল নই, আমি স্পেন।’ আমি বলি, সে কী? কেন? মেয়ে বলল, ‘তোমরা সারা বছর খেলা দেখো না, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ দেখো না, স্প্যানিশ লিগ দেখো না।
তোমরা আছ শুধু ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে। এবার চ্যাম্পিয়ন হবে স্পেন।’ আমি হাসলাম। প্রথম ম্যাচেই স্পেন গেল হেরে। সেই স্পেন চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল। বুঝলাম, মেয়ে এবং ফুটবল—দুইই আমাদের মতো পুরোনো প্রজন্মের লোকদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
আমার মেয়ে থাকে আটলান্টিকের ওই পারে। আমার সঙ্গে তার যোগাযোগের একটা উপলক্ষ ফুটবল। রাতের বেলা খেলা দেখে তাকে টেক্সট করি। স্পেন আউট। ইংল্যান্ড জিতে গেছে। সেও আমাকে বার্তা পাঠায়। আমরা দুজন দুই মহাদেশে দুই মেরুতে থাকি, ফুটবল আমাদের কানেকটেড রাখে, যুক্ত করে দেয়।
ফুটবল আবার বাংলাদেশের মানুষকে যুক্ত করছে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা কোপার চূড়ান্ত লড়াইয়ে মুখোমুখি। বাংলাদেশের মানুষ জেগে উঠছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতার চর্চা হচ্ছে! ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা আছে বলেই আমরা মুক্তবাক হতে পারছি। একবার বিশ্বকাপের সময় আমি বাসে করে কক্সবাজারে যাচ্ছিলাম। সারাটা পথে মনে হলো, দুই ধারে, আর্জেন্টিনার পতাকা লম্বা করে প্যান্ডেলের মতো করে টাঙানো।
প্রতিটি ভবনচূড়ায়, টিনের চালে, গাছের ডালে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকা। কেউ কেউ আবার নিজের পুরো বাড়ি হলুদ–সবুজে রঞ্জিত করে ফেলেন বিশ্বকাপের সময়।
জানি না, আবার যখন বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসবে, আগামী বছরই তো কাতারে বসার কথা, তখন বাংলার মানুষ আবার হলুদ-সবুজ, সাদা-নীল দিয়ে বাংলার আকাশ ঢেকে দেবে কি না! নাকি ইউরোপের নানা দেশের লীগ দেখে দেখে মানুষের রুচি আর সমর্থন পাল্টাচ্ছে! পাল্টাতে পারে। না–ও পারে।
কিন্তু আমরা যারা কোভিডের টিকা নেওয়ার বয়সে পৌঁছে গেছি, তাদের কাছে ফুটবল মানেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। আর ফুটবল মানেই স্মৃতির ফোয়ারায় আপাদমস্তক স্নাত হওয়া। যেহেতু জীবন মানে স্মৃতি, তাই ফুটবল মানেও জীবন আমাদের।
এখন কোটি টাকার প্রশ্ন! কে জিতবে এবারের কোপা! আমি তো সম্ভাবনা দেখি ৫০-৫০। নিজেদের মাঠে ব্রাজিল ছেড়ে কথা কইবে না। আর মেসির আর্জেন্টিনা তো বেশ শক্তপোক্তই মনে হচ্ছে! খেলাটা জমবে আশা করা যায়!
তবে এবারের খেলা, সে ইউরোই বলুন, আর কোপাই বলুন, যত না পায়ের খেলা, তারও চেয়ে মনে হচ্ছে হাতের খেলা। জার্সি ধরে টান মারা, গোপনে পেছন দিক থেকে দুই হাতে আটকে রাখা, ধাক্কা মারা—এসবই যেন হচ্ছে বেশি।
যে আঘাত করে, আক্রান্ত হয়ে ব্যথাহত হওয়ার অভিনয়টা সেই করে বেশি। তখন মনে হয়, ফুটবল দেখছি, নাকি নাট্যাভিনয় দেখছি।
কী আর করা! ফুটবল মানে যেহেতু জীবন, আর জীবন হলো একটা নাট্যমঞ্চ, আমরা সবাই অভিনেতা—শেকস্পিয়ারের কথাটাই বা আমরা ফেলব কী করে! ফুটবলাররাও তো অভিনেতাই বটে।