মাদক নির্মূলে দেশব্যাপী অভিযান অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ভয়ংকর সব মাদকের দাপট এখন বাংলাদেশে। ইয়াবা, আইস, এলএসডি, ডিএমটি, খাত, কোকেন, এনপিএস নামের এসব ভয়ংকর মাদক দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীসহ সারা দেশে।
করোনায় মাদকবিরোধী অভিযানে কিছুটা ভাটা পড়ে। এই সুযোগে অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে, গরুর পেটে, কুরিয়ার ও ডাকযোগসহ বিভিন্ন পার্সেলের মাধ্যমে নানান কৌশলে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে মাদক। আগে টেকনাফ দিয়ে ইয়াবার চালান আসতো। এখন টেকনাফের পাশাপাশি সকল সীমান্ত দিয়ে মাদক আসছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারের পাঁচটি সংস্থা মাদক ব্যবসায়ীদের যে তালিকা জমা দিয়েছে তা পর্যালোচনা করে ১৪ হাজার মাদক ব্যবসায়ীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এরমধ্যে সারাদেশে মাদকের গডফাদার রয়েছেন ৯০০ শতাধিক। শুধু রাজধানীতে আছেন ৩৭ গডফাদার।
মাদকের বেশিরভাগ গডফাদার দুবাই, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছেন। চিহ্নিত গডফাদাররা গা-ঢাকা দিলেও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ‘হোম ডেলিভারি’ হচ্ছে বিভিন্ন মাদক। মাদক ব্যবসায় ব্যবহার করা হচ্ছে সুন্দরী টিনএজ মেয়েদের।
রাজধানী থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত এখন মাদকের ছড়াছড়ি। দুঃখজনক ও ভয়াবহ উদ্বেগের সংবাদ হলো হেরোইন, কোকেন, খাত, এনপিএস, ইয়াবার পর এলএসডি পৌঁছে গেছে তরুণদের হাতে। এক শ্রেণির তরুণ নেশার জন্য ব্যবহার করছে আইস। আইস মূলত এমপিটামিন ট্যাবলেট। এটি ইয়াবার চেয়ে বেশিও উত্তেজনা সৃষ্টিকারী মাদক।
ভয়াবহতার দিক থেকে পশ্চিমে এলএসডিকে বলা হয় ‘লাস্ট স্টেজ অব ড্রাগ’। এলএসডিতে আসক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী প্রকাশ্যে নিজের গলায় দা চালিয়ে দেওয়ার পর এ মাদকের বিষয়টি সামনে আসে।
কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের চিকিত্সক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রায়হানুল ইসলাম বলেন, খুবই ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি। এটি সেবনে আত্মাহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। একজন সেবন করে, সঙ্গী তিনজন তাকে পাহারা দিতে হয়। নইলে গাড়ি চালানোসহ কোনো কিছু করতে থাকলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
এছাড়া আরেকটি মাদক হলো ম্যাজিক মাশরুম। এলএসডি মাদকে যে প্রতিক্রিয়া হয় এ মাদকেও তাই হয়। বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত তরুণরা এসব ভয়ঙ্কর মাদকে আসক্ত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রাখার পাশাপাশি অভিভাবকসহ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা না হলে তরুণ সমাজকে রক্ষা করা কঠিন হবে।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, ভয়ঙ্কর মাদক পাচারে সুন্দরী মেয়েদের ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা সব কিছুতে ব্যবহৃত হয়ে নিজেরাই মাদকে জড়িয়ে পড়ছে। মাদকসহ আন্ডারওয়ার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ আছে ওই সুন্দরীদের।
মাদক বহন করা যায় সহজে, মুনাফাও অধিক। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই চিত্রনায়িকা পরীমনির বাসায় অভিযান চালানো হয়। তারা আরো বলেন, করোনার কারণে এখন ছেলে- মেয়েরা ঘরে বসে আছে। এ কারণে অনেকে মাদকাসক্ত হচ্ছেন।
আর মাদক কেনা-বেচার সাথে নিম্নবিত্ত থেকে অভিজাত পরিবারের সন্তানরা জড়িয়ে পড়ছে। আর এসব কেনাবেচায় পৃষ্ঠপোষক হলেন এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা।
যুব সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে অভিযান চালাতে হবে। একই সঙ্গে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
কর্মকর্তারা আরো বলেন, ইতিমধ্যে সারাদেশে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কুরিয়ার সার্ভিস ও ডাক বিভাগের পার্সেলেও নজরদারি বাড়াতে হবে। মাদক ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত কৌশল পরিবর্তন করে। তবে সবাই ঐক্যবদ্ধ হলে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
এদিকে মাদকের সাথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর কর্মকর্তারাও জড়িত। থানা, এসপি অফিস ও ডিআইজি রেঞ্জের এক শ্রেণীর কর্মকর্তারা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকেন।
এই টাকার ভাগ আবার উপরেও যায়। মাদক কেনাবেচা গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ার আরেকটি কারণ এটি। অনেক ওসি ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে পোস্টিং নেন যে থানায় আয় বেশি সেখানে।
আর সেই টাকা তুলতে মাদক ব্যবসার সাথে তারা হাত মেলান। রেঞ্জের ডিআইজি থেকে ওসি পর্যন্ত কর্মকর্তারা মাদকের ব্যাপারে আপোষ না করলে সহজে মাদক নির্মূল করা সম্ভব হবে।
পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। আমরা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে নীতি নিয়ে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। একই সঙ্গে পুলিশে যারা জড়িত তাদেরও শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ঘর থেকে অভিযান শুরু করেছি।
র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে পরিমনির বাসায় অভিযান চালানো হয়। পরে তার দেওয়া তথ্যের মাধ্যমে অন্যদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, করোনার কারণে মাদকবিরোধী তল্লাসি এখন কম হয়।
এই সময়ে নানা কৌশলে মাদক ব্যবসায়ীরা মাদকের চালান দেশে আনছে। তবে যত কৌশল গ্রহণ করা হোক না কেন, র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারিতে তারা ধরা পড়বেই। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। গতকালও চট্টগ্রামে ৫০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করেছে র্যাব। তিনি বলেন, ২০১৯ ও ২০২০ সালে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার করেছে র্যাব।
চলতি বছরের এই ছয় মাসেও সমসংখ্যক মাদক উদ্ধার করা হয়। মাদকের বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযোগ অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।