অনেক মানুষকেই বলতে শুনা যায় যে, বুকের বাম পাশে চিন চিন ব্যাথা করে। কিছুক্ষণ হাঁটলে হাঁপিয়ে যায় কিংবা বুক জ্যাম হয়ে আছে বলে মনে হয়।আসুন জেনে নিই,এই ব্যাথা কি হার্টের সমস্যার কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে হচ্ছে এবং তা বুঝার উপায় কি?বুকের বাম পাশে ব্যাথার কারণ-বুকের বাম পাশে ব্যাথার অনেক কারণ রয়েছে, তার মধ্যে খুব সাধারণ চারটা কারণ উল্যেখ যোগ্য,
১. IHD বা হার্টের রক্তনালিতে চর্বি জমা জনিত কারন
২. হার্ট অ্যাটাক
৩. প্যানিক অ্যাটাক
৪. গ্যাস্ট্রাইটিস বা অ্যাসিডিটি সমস্যা;
১.ইশকেমিক হার্ট ডিজিজ যেভাবে বুঝবেনঃ
সাধারণত আমরা হৃদরোগ বলতে যা বুঝি, তা মূলত ইশকেমিক হার্ট ডিজিজকেই বুঝাই। এই রোগে হার্টের মধ্যে যে রক্তনালিগুলি আছে তাতে চর্বি জমে রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয় তাই ব্যাথা অনুভব হয়। সাধারণত এই রোগ ৪০ বছরের আগে হয় না এবং যাদের এই রোগ থাকে তাদের অধিকাংশেরই হাই ব্লাড প্রেশার থাকে তাই কারো যদি বয়স ৪০ এর অধিক হয় এবং বুকে চিনচিন ব্যাথা করে এবং তার হাইপ্রেশার থাকে তাহলে হৃদরোগের কথা মাথায় রাখতে হবে।
এইক্ষেত্রে কিছুক্ষণ ভারি কাজকর্ম করলে কিংবা একটু হাঁটাহাঁটি করলে কিংবা সিড়ি দিয়ে উপরে নিছে উঠা নামা করলে বুকে চিনচিন ব্যাথা শুরু হয় এবং সাথে হাঁপিয়ে উঠে, শ্বাস নিতে ব্যাথা অনুভব হয়, বুক ধরপর করে, ব্যাথা বাম বাহু ও ঘাড়ের দিকেও যেতে পারে এবং সাথে শরীর ঘামিয়ে যেতে পারে কিছুক্ষণ পর আবার এই ব্যাথা চলে যায়, এইরকম দুই একদিন পরপর হতে পারে, আবার খাবার বেশি খেলেও চিন চিন ব্যাথা শুরু হয়, কারণ খাবারের পর কিংবা ভারি কাজকর্ম করলে কিংবা হাঁটাহাঁটি করলে হার্টের অধিক পরিমান রক্তের দরকার হয়। তবে যাদের ইশকেমিক হার্ট ডিজিজ রয়েছে তাদের রক্ত সঞ্চালন কম হয় তাই এই ব্যাথা হয়।
করণীয়.
জরুরি হার্ট বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বা কার্ডিওলজিস্ট দেখাতে হবে।ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, রক্তে চর্বির পরিমান দেখতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলাফেরা করতে হবে।
যদি প্রেশার বেশি থাকে এবং তা নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য মেডিসিন খেতে হবে এবং হার্টের উপর কাজের চাপ কমানোর জন্য ঔষধ খেতে হবে। কোলেস্টেরল কমানোর ঔষধ এবং রক্ত চলাচল সচল রাখার ঔষধ খাওয়া লাগতে পারে এবং ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতিত ঔষধ কখনো বন্ধ করা যাবে না। সাথে চর্বি জাতীয় খাবার ও লবণ, ধুমপান অ্যালকোহল ইত্যাদি পরিহার করে চলতে হবে। লাইফ স্টাইল নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক্ষেত্রে।
হার্ট অ্যাটাক জনিত বুক ব্যাথা-
সাধারণত ৪০ বছরের নিচে হার্ট অ্যাটাক হয় না। যাদের হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে তাদের আগে থেকেই হাই ব্লাড প্রেশার কিংবা রক্তনালি জনিত রোগ ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ থেকে থাকতে পারে।অধিকাংশ হার্ট অ্যাটাক রোগীর ইতিহাস নিয়ে জানা যায় যেইদিন হার্ট অ্যাটাক হয়েছে সেইদিন কিংবা আগের দিন তারা প্রেশার এর ঔষধ খায়নি তাই হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে।
এমন অনেক আছে, তাদের যে হাই প্রেশার রয়েছে কিংবা পূর্ব থেকে হৃদরোগ আছে। কখনো ডাক্তার এর কাছে না যাওয়ার কারণে তারা তা জানতেই পারেনা৷ দেখা যায়,সবাই বলাবলি করে সকালে সুস্থ দেখলাম হঠাৎ ঘুরে পড়ে মারা গেছেন!
হার্ট অ্যাটাক এর ব্যাথা যেভাবে বুঝবেন–
বয়স সাধারণত ৪০ এর অধিক হয়ে থাকে। আগে থেকে তার হাইব্লাড প্রেশার ছিলো কিংবা অন্য কোনো হৃদরোগ ছিলো। হঠাৎ খাবারের পর কিংবা কোনো জার্নি করার পর কিংবা হাঁটাহাঁটি বা ভারি কোনো কাজ কর্ম করার পর অথবা কারো সাথে চিৎকার দিয়ে কথা বলার পর কিংবা কোনো দুঃশ্চিতার সময় বুকের বাম পাশে চাপচাপ ব্যাথা শুরু হয়। মন হবে বুক জ্যাম হয়ে যাচ্ছে। ব্যাথা পর্যায়ক্রমে বাড়তেই থাকবে, ব্যাথা পেটের দিকে, পিঠের দিকে, বাম বাহুর দিকে ও ঘাড়ের দিকে ছড়িয়ে পড়বে। ব্যাথার তীব্রতায় রোগী দাঁড়ানো থেকে বুক ধরে বসে যাবে কিংবা শুয়ে পড়বে, কপালে মুখে ঘাম দেখা দিবে।
বমি বমি ভাব অথবা বমি হয়ে যাবে। ব্যাথা কমবেনা, বাড়তেই থাকবে। সাধারণত ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ এর ব্যাথায় রোগী পিছনে কিছুতে হ্যালান দিয়ে বসলে ব্যাথা কমে যায় তবে হার্ট অ্যাটাক এর ক্ষেত্রে ব্যাথার তীব্রতা বাড়বে, ব্যাথা কমবেনা। তীব্র হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলে সঠিক সময় চিকিৎসা করাতে না পারলে রোগী মারা যেতে পারে।
করণীয়- যদি হার্ট অ্যাটাক বুঝতে পারেন তাহলে সাথে সাথে ইমার্জেন্সি চিকিৎসা হিসাবে ৪ টা অ্যাসপিরিন ৭৫ মিঃগ্রাঃ ট্যাবলেট, ৪ টা ক্লোপিডোগ্রেল ৭৫ মিঃগ্রাঃ ও একটা নাইট্রোগ্লিসারিন ট্যাবলেট ও অ্যাটর্ভাস্ট্যাটিন ট্যাবলেট পানিতে মিশিয়ে কিংবা রোগীকে দিয়ে চিবিয়ে খাইয়ে দিতে হবে এবং সাথে সাথে হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে।
প্যানিক অ্যাটাক জনিত বুকে ব্যাথাঃ
সাধারণত ৪০বছর বয়সের নিচেরদিকে লোকদের প্যানিক অ্যাটাক বেশি দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে রোগীর পূর্ব থেকে হাইপ্রেশার কিংবা অতিরিক্ত কোলেস্টেরল এর কোনো রেকর্ড থাকে না। যেইসব মানুষ অতিমাত্রায় দুঃশ্চিতা করে কিংবা কোনো কিছু নিয়ে ভয়ে থাকে। সেমনঃ পরীক্ষা ভীতি, জীবন নিয়ে ভয়ভীতি, তাদের ক্ষেত্রে প্যানিক অ্যাটাক দেখা যায়। হঠাৎ বুকে ব্যাথা শুরু হবে, মনে হবে যে বুক ছিড়ে যাচ্ছে, শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হবে, রোগী বলবে কিংবা তার কাছে মনে হবে একটু পর সে মরে যাচ্ছে অর্থাৎ প্যানিক অ্যাটাক এর রোগীর কাছে খুব মৃত্যুভয় কাজ করবে তার হাতে পায়ে কাঁপুনি আসতে পারে, বুক ধরপর করবে।
ইসিজি করলে নরমাল রিপোর্ট আসবে। এক্ষেত্রে করণীয়, রোগীর সাথে মন খুলে কথা বলে তাকে অভয় দেওয়া এবং সে সুস্থ হয়ে যাবে নিশ্চয়তা দেওয়া। যেহেতু এটা একটা মানসিক রোগ তাই পরবর্তীতে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন।
গ্যাস্ট্রাটিস বা অ্যাসিডিটি জনিত বুকে ব্যাথাঃ
এই ক্ষেত্রে ব্যাথা বুকের বাম পাশে না হয়ে বুকের উপরিভাগে ব্যাথা হবে। ব্যাথার মধ্যে একটা জ্বালাপোড়া ভাব অনুভব হবে। খাবারের পরে ব্যাথা বেড়ে যাবে, খাবারের সময় একটা প্রতিবন্ধকতা মনে হবে, বমি ভাব বা বমি হতে পারে, সাধারণত হঠাৎ করে রোজা রাখলে কিংবা খাবারে অনিয়মিত ভাব থাকলে কিংবা অত্যাধিক ঝাল খাবার কিংবা তৈলাক্ত খাবার খেলে গ্যাস্ট্রাটিস হয়ে বুকে ব্যাথা হতে পারে।
হার্টের ব্যাথায় যেমন বুক চিন চিন করে কিংবা ব্যাথা হাতের বাহু ও গাঁড়ে ছড়িয়ে পড়ে। গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা এমন হয় না।কারো কারো ক্ষেত্রে মনে হবে তার পেট পিঠ দুইটাই ব্যাথায় ভেংগে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। সাথে বমি হচ্ছে, আবার কারো কারো ঢেকুর আসবে।হার্টের ব্যাথা যেমন সাধারণ ৪০ বছরের পরে শুরু হয়, সেইক্ষেত্রে গ্যাস্ট্রাটিস এর ব্যাথে যে কোনো বয়সেই হতে পারে। গ্যাস্ট্রাটিস এর রোগীর হাইপ্রেশার থাকতেও পারে আবার নাও পারে তবে হৃদরোগের রোগীর হাইপ্রেশার কিংবা রক্তে অতিরক্তি কোলেস্টেরলের ইতিহাস থাকবে।
করণীয়ঃ
গ্যাস্ট্রাটিস জনিত বুক ব্যাথা সাধারণত অ্যান্টাসিড জাতীয় সিরাপ যথা অ্যান্টাসিড প্লাস সিরাপ খেলে কমে যায়।
এসব ক্ষেত্রে ডাক্তার এর শরণাপন্ন হওয়া দরকার। কারণ অনেক সময় যদি গ্যাস্ট্রিক আলসার হয়ে থাকে৷ সেই ক্ষেত্রে মুখে খাবার বন্ধ করে শিরাপথে ইঞ্জেকশন /স্যালাইন এর মাধ্যমে চিকিৎসা করা প্রয়োজন হতে পারে।
ডাঃ ইসমাইল আজহারি
পরিচালক, সেন্টার ফর ক্লিনিক্যাল এক্সিলেন্স এন্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ