টাঙ্গাইল সদর উপজেলার যমুনা তীরবর্তী দুর্গম চর—মহেষপুর চড়, জাঙ্গালিয়া, মিলুয়ার চড়, চিপিচাপড়ি ও সৌরদউল চড়—আবারও পরিণত হয়েছে ভয়-আতঙ্কের জনপদে। দিনের আলো ফুরোতেই পুরো এলাকা হয়ে ওঠে অনিরাপদ, আর রাত নামলেই যেন জেগে ওঠে সন্ত্রাসী চক্রের দৌরাত্ম্য।
সর্বহারা আত্মসমর্পণের দুই বছর পরও ফের সক্রিয় একই চক্র ২০২৩ সালে টাঙ্গাইল সদর থেকে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (সর্বহারা)–এর ৭৮ সদস্য আত্মসমর্পণ করায় কিছুদিন স্বস্তি ফিরেছিল স্থানীয়দের মনে। তবে অভিযোগ উঠেছে—আত্মসমর্পণকারী অনেকেই আবার ফিরে এসেছে পুরোনো অপরাধচক্রে। এর মধ্যে বাপ্পি, মিলন, পাশান, জয়নালসহ কয়েকজন পুনরায় চাঁদাবাজি ও অবৈধ বালু উত্তোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে দাবি এলাকাবাসীর।
ট্রলারের মাঝিকে অপহরণ–মারধরের অভিযোগ,৩ ডিসেম্বর ২০২৫, জাঙ্গালিয়া মৌজায় নদী পথে যাওয়ার সময় ট্রলারের মাঝি ফারুক হোসেন দেখতে পান রাতের আঁধারে একটি চক্র চর কেটে বালু উত্তোলন করছে। বিষয়টি টের পেয়ে চক্রের নেতারা তাকে আটক করে তাদের ড্রেজারে নিয়ে মারধর ও টাকা দাবি করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরে ট্রলার মালিক পরিবার নৌপুলিশকে খবর দিলে পুলিশ ফারুককে উদ্ধার করে।
তবে টাঙ্গাইল নৌ পুলিশ সুপার সোহেল রানা গণমাধ্যমকে জানান—“ঘটনাটি অপহরণ নয়, সন্দেহজনক ঘোরাফেরার কারণে তাকে আটক করা হয়েছিল।” তবে পুলিশকে আগাম অবহিত না করেই কোনো ব্যক্তি কাউকে এভাবে আটক করতে পারে কি না—এমন প্রশ্নে তিনি কোনো স্পষ্ট জবাব দেননি।
চরাঞ্চলের ঘরবাড়ি বিলীন—ঝুঁকিতে যমুনা সেতু
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ‘সেকশন কাটার মেশিন’ বসিয়ে রাতের আঁধারে বালু উত্তোলন করছে চক্রটি। এর ফলে চরাঞ্চলের বহু বাড়িঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে রয়েছে দেশের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা—যমুনা বহুমুখী সেতু ও যমুনা রেল সেতু।
অবৈধ বালু উত্তোলন—যে আইনে যে শাস্তি
সেতু, বাঁধ, নদীতীররক্ষা ও KPI এলাকায় বালু উত্তোলন আইনত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিভিন্ন আইনে এ কর্মকাণ্ডকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। মূল শাস্তিগুলো হলো—বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০: ২–৫ বছর কারাদণ্ড, ৫০ হাজার–১ লাখ টাকা জরিমানা, যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫: পরিবেশ নষ্ট করলে ৩–১০ বছর কারাদণ্ড, ৩–১০ লাখ টাকা জরিমানা
পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০০০: ১ বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দণ্ডবিধি ১৮৬০: জননিরাপত্তা বিপন্ন করলে ৬ মাস কারাদণ্ড KPI নিরাপত্তা আইন: যমুনা সেতুর আশপাশে অবৈধ কার্যক্রমে ১–৩ বছর কারাদণ্ড।
ইউএনওর অবস্থান:“টাঙ্গাইলে কোনো বৈধ বালুমহাল নেই, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না” জাঙ্গালিয়া–কলাবাগান চ্যানেলে অবৈধ ড্রেজিং চলমান কি না জানতে চাইলে টাঙ্গাইল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান“টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় কোনো বৈধ বালুমহাল নেই। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করতে কাউকে দেওয়া হবে না।”তিনি আরও বলেন,“সংবাদ প্রকাশের পরপরই এসিল্যান্ডকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। দুটি ড্রেজার দেখা গেলেও বালু উত্তোলনের কার্যক্রম তখন চলমান ছিল না।”
চরবাসীর প্রত্যাশা:“রাতের ভয় কাটুক, ফিরে আসুক নিরাপত্তা”স্থানীয়দের দাবি, সন্ত্রাসী চক্রটির বিরুদ্ধে দ্রুত শক্তিশালী অভিযান না হলে আবারও পুরো চরাঞ্চল আগের মতো সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির কবলে পড়ে যাবে। তারা বলেন—“নদী, চর আর সেতু বাঁচাতে হলে অবৈধ ড্রেজিং বন্ধ করতে হবে। নয়তো সব ঘরবাড়ি ভেঙে নদী গিলে খাবে।”
টাঙ্গাইলের দুর্গম চরাঞ্চলে আবারও যে,অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে—তা স্পষ্ট। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে—এই জনপদ আবার শান্তিতে ফিরবে, নাকি অন্ধকারে তলিয়ে যাবে।













