
শীত শেষে গরম হাওয়ায় ভর করে আসছে গ্রীষ্ম। আর গ্রীষ্ম এলেই রান্না গ্যাস নিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলেন গৃহিনীরা। গ্যাস কিনতে পকেট শুকায় বাড়ির কর্তাদের! বছরের শুরুতেই দ্বিতীয় দফায় আবারও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন ভোক্তারা।প্রাকৃতিক গ্যাস কমে যাওয়ায় বাজারে দাম চড়ছে এলএনজিরও! সরকার বলছে প্রাকৃতিক গ্যাস কমে যাওয়ায় এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করতে হচ্ছে। কিন্তু গ্রিডেও গ্যাস সরবরাহ অপ্রতুল।
স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে গ্রিডে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে এলএনজি। আর সরবরাহের এই বড় ঘাটতির কারণে রাজধানীসহ অন্যান্য শহরের আবাসিক বাড়িগুলোতে শুরু হয়েছে গ্যাস সংকট। এ সংকট তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে এলএনজি আমদানির জন্য অর্থ বিভাগের কাছ থেকে টাকা চেয়ে পাচ্ছে না বলে দাবি করেছে পেট্রোবাংলা।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, এলএনজির দুইটি ভাসমান টার্মিনালের কাজ পরিচালনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে অর্থ বিভাগের কাছে গত ২০ জানুয়ারি চিঠি দিয়ে ১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা চায় পেট্রোবাংলা। এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগের সহযোগিতা নেওয়া হলেও অর্থ বিভাগ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি দাবি পেট্রোবাংলা সূত্রের।
পেট্রোবাংলার এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (ক্যাব) উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম ভোরের পাতাকে বলেন, ‘এ সবই পেট্রোবাংলার এক তরফা কথা। গ্যাস উত্তোলনের জন্যে যে দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ, সেটা তছরুফ করছে তারা। বরাদ্দের টাকাও যথার্থ ব্যবহার করছে না। সেজন্য ক্যাব এই টাকার হিসাব চেয়েছিল। সে টাকার হিসাব তারা দিচ্ছে না। এই টাকা খরচ করার নিয়ন্ত্রণ তারা তাদের নিজেদের হাতে রেখেছে। সেই টাকা দেওয়া হয়েছিল দেশীয় কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা তৈরি করার জন্যে।
দেশীয় কোম্পানিগুলোকে এই টাকা দিয়ে তাদের দিয়ে গ্যাস উত্তোলন করা হলে মন্ত্রণালয়ের আর আলাদাভাবে টাকা দেওয়া লাগে না।’
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, দেশে এখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি ও দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেমিটিক গ্রুপের দুইটি এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। বিশ্ববাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণে গত কয়েকমাস ধরে এলএনজি আমদানিতে অর্থ যোগানো ঘাটতি রয়েছে।
জানা গেছে, এলএনজি আমদানিতে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। মোট ৭৬টি কার্গো গ্যাস আমদানির লক্ষ্যে এরই মধ্যে ৩৫টি কার্গো আমদানি করা হয়। এবার এলএনজির দাম বিশ্ববাজারে টনপ্রতি ৩০ ডলার করে বাড়তি থাকায় রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস লিমিটেড- আরপিজিসিএল গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে খোলা বাজার থেকে এলএনজির দুটি চালান বাতিল করা হয়।
বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলেই দেশে তার প্রভাব পড়ছে- এ দাবি সরকার সংশ্লিষ্টরা করলেও এতে দ্বিমত জানিয়ে ক্যাব উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, ‘বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি আমাদের কাছে গুরুত্ব বহন করে না। কারণ, আমাদের দেশেই তো গ্যাস উত্তোলন নিয়ে নানা টালবাহানা চলছে। এই গ্যাসই যদি সঠিকভাবে দেশীয় কোম্পানি দিয়ে উত্তোলন করা হয় তবে বিশ্ববাজারের সাথে তুলনার প্রয়োজন হয় না।’
এ বিষয়ে আরো যোগ করে ক্যাব’র সংগঠক রুহিন হোসেন প্রিন্স ভোরের পাতাকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে কখনো কখনো বিশেষ করে শীত মৌসুমে গ্যাসের দাম বেড়ে যায় বটে। ওই সময় এশিয়ার দেশগুলোতে দাম একটু বর্ধিত স্তরে থাকে। তবে আমরা হিসেব করে দেখেছি এই দাম বৃদ্ধিটা সাময়িক, হিসেবটা করতে হবে গড়ে বছরের হিসেবে। ফলে, দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে তাদের দেওয়া হিসেবটা অযৌক্তিক।’
সব মিলিয়ে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে এলএনজি সরবরাহ না বাড়ালে লোডশেডিং সামাল দেওয়া কঠিন হবে। আবার দিনের বেলাতেও তরলীকৃত জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল রাখতে হলে খরচ আরো বেশি বেড়ে যাবে। ভর্তুকি বাড়বে বিদ্যুৎ উৎপাদনে।
জানা যায়, ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় ২০ থেকে ২২ টাকা। ফার্নেস অয়েলে উৎপাদন খরচ ৮ থেকে ৯ টাকা। আর গ্যাসে উৎপাদন খরচ পড়ে ৪ টাকা। সরকার মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে খরচ আরও কম; সর্বোচ্চ আড়াই টাকা প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ। এখন যদি গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন তেলের ওপরে নির্ভর করতে হয়, তবে বড় অঙ্কের ভর্তুকি গুণতে হবে সরকারকে।
এ বিষয়ে রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘এ তথ্য মোটেও যথাযথ নয়। গরমকালে ইলেক্ট্রিসিটি কম ব্যবহার হয় শীতকালের তুলনায়। গ্যাসের সাথে ইলেক্ট্রিসিটির উৎপাদন সম্পর্ক থাকায় শীতকালে গ্যাস সংকট হয়। গরমকালে এ সংকট থাকার কথা নয়।’
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সরবরাহ হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর সঙ্গে এলএনজি সরবরাহ করা হয় আরও ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু গত ডিসেম্বরে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি কমে যায়। ফলে জাতীয় গ্রিডে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমে যায়। এর প্রভাব এরইমধ্যে রাজধানীর বাসাবাড়ি শিল্প কারখানায় পড়তে শুরু করেছে।
ফেব্রুয়ারিতে আরও ২০০ মিলিয়ন এলএনজি যোগ করে মোট ৪০০ মিলিয়ন সরবরাহ করা হলেও সংকট কমছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এমনিতেই পাইপলাইনে কনডেনসেট জমে যাওয়ায় শীতকালে গ্যাসের চাপ ঠিক রাখতে কম্প্রেসার বাড়াতে হয় বিতরণ কোম্পানিগুলোকে।
গ্যাস সরবরাহ কম হওয়ার এটিও কারণ বলে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এদিকে গ্যাসের বাড়তি চাহিদা মেটাতে দ্রুত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির কথা জানিয়েছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি অর্থনৈতিক ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘দরকার বলেই এলএনজি খোলা মার্কেট থেকে কিনেছি। কিন্তু বিভিন্ন সোর্স থেকে আমাদের যে লং টাইম চুক্তি রয়েছে সেগুলো অব্যাহত রাখা হবে।’
গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর এলপিজি’র (তরল পেট্রোলিয়াম) দাম নিয়ে আদালতে বিইআরসি’র চেয়ারম্যানের ক্ষমা প্রার্থনা করার পর গত ১৪-১৫ জানুয়ারি হয় এলপিজির দাম নির্ধারণের গণশুনানি। গণশুনানিতেও উঠে এসেছিল বাজারে বাড়তি দামের বিষয়টি।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের দাবি ছিল একশ’ টাকা বাড়ানোর। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তাবে আড়াইশো থেকে তিনশো টাকার বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। সে সময় কমিশন সব কিছু পর্যালোচনা করে ভোক্তাস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই দাম ঠিক করার কথা বললেও দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাচ্ছে এলপিজি গ্যাসের দাম। দাম নিয়ে প্রথম গণশুনানিতে নিজেদের প্রস্তাব তুলে ধরে সরকারি প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেড ও বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সংগঠন এলপিজি অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।
এলপিজিএলের সাড়ে ১২ কেজি এলপিজির দাম বর্তমানে ৬০০ টাকা হলেও শুনানিতে ৭০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। তবে এলপিজিএলের তহবিলে ৩৩৩ টাকা বিবেচনায় নিয়ে ৯০২ টাকা করার প্রস্তাব করে বিআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। অন্যদিকে, বেসরকারি কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে ওঠানামার অনুযায়ী মাসিক দাম নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে।
ডিসেম্বর মাসের হিসেবে যা ১২৫৯ টাকা প্রস্তাব করা হয়। যদিও বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি ৮৬৬ টাকা দাম নির্ধারণ করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছে। গণশুনানিতে বিগত বছরের ২৫ আগস্ট আদালতের আদেশের পর যারা এলপিজির দাম বাড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছিল ক্যাব।
গণশুনানির পরও দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ক্যাব উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, ‘মূলত করপোরেট কালচার প্রমোট করতে গিয়ে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে। সরকার নিজেও এখন ব্যবসায়ী হয়ে গেছে। সরকার নিজেও এখন ট্যাক্স ভ্যাটের পাশাপাশি মুনাফা চায়। এই দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যার সেই বিইআরসি-ই নিষ্ক্রিয়। কারণ, তাকে নিয়ন্ত্রণ করে জ্বালানি বিভাগ। জ্বালানি বিভাগ আবার নানা রকম আইনের ব্যত্যয় করে ব্যবসায়ীদের দাম বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।’
এ বিষয়ে আরো যোগ করে রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের এখতিয়ার নেই দাম বাড়ানোর। এই দাম বৃদ্ধির বিষয়টি ভাববে বিইআরসি। আশা করেছিল, তাদের কথা বিবেচনা করে দাম ধার্য করা হবে। কিন্তু, এখনো সে ঘোষণা দেওয়া হয়নি। বরং বিভিন্ন জায়গায় গ্যাস সিলিন্ডারের দাম বাড়ানো হচ্ছে।
ঢাকা শহরে থেকে দুই সিলিন্ডারের গ্যাস ৯৭৫ টাকা এবং এক সিলিন্ডারের ৫৫০ টাকা দিতে হয়। ক্যাব গত গণশুনানিতে প্রমাণ করেছিল এই টাকাটা বাড়তি নেওয়া হয়। এখানে যদি গ্যাসে মিটার দেওয়া হত তবে, বর্তমানের এই বর্ধিত দাম নিয়ন্ত্রণ করা যেত। ৫০০-৬০০ টাকার বেশি হত না।
ঢাকা শহরের যেসব অঞ্চলে মিটার দেওয়া হয়েছে, তাতে এটা প্রমাণ করা গেছে। এর জন্য ক্যাবের দাবি ছিল দ্রুত মিটার সংযোগ দেওয়া হোক। কিন্তু কর্তৃপক্ষ লুটপাট অবাহত রাখবে বলে, মিটার সংযোগ দিচ্ছে না।’
গ্যাসের সংকটের সমাধান চেয়ে তিনি আরো বলেন, ‘গ্যাসের কোন সংকট নেই। যা আছে সেটা পরিকল্পিত। আমাদের যদি নতুন কোন কূপ অনুসন্ধান করা হত এবং সঠিকভাবে নিয়ম করে গ্যাস উত্তোলন করা হত, তবে এখন যে বিদেশ থেকে গ্যাসের আমদানি নির্ভরতা করা হয়েছে, সেটা হত না।
গ্যাসের সংকটটি আসলে কৃত্রিম সংকট। আমরা আশা করি সরকার জনগণের দিকটিই বিবেচনা করবে, ব্যবসায়ীদের স্বার্থ নয়।’