
সিরাজগঞ্জের চৌহালীর কয়েকটি গ্রাম এখন ‘মুমূর্ষু’। যমুনা শেষ ১০ বছরে চৌহালী উপজেলাকে করে দিয়েছে দুই টুকরা, যার বড় অংশই এখন পূর্ব পারে, যেখানে টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলা। বাকি অংশ পশ্চিম পারে, যেখানে সিরাজগঞ্জের চৌহালী। মাঝখানের সাত কিলোমিটার পুরোটাই যমুনাগর্ভ, যা বর্ষা এলেই হয়ে ওঠে ঢেউয়ে ঢেউয়ে উত্তাল। এসব নিয়েই দুই পারের মানুষের বৈরিতা।ভাঙনকবলিত মানুষ পূর্ব পারে বাস করলেও তাদের নানা কাজে ছুটতে হয় যমুনা পাড়ি দিয়ে পশ্চিম পারে। বিশেষ করে জেলা পর্যায়ের কোনো কাজ নিয়ে সিরাজগঞ্জ যেতে হলে অবশ্যই যমুনা পাড়ি দিতে হয়।
আর এ জন্য যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ইঞ্জিনচালিত নৌকা। নৌকাও সব সময় পাওয়া যায় না। ফলে যমুনার ভাঙন তাদের পশ্চিম পার থেকে বিচ্ছিন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে দুর্ভোগও বাড়িয়েছে। চৌহালীর পূর্ব পারের গ্রামগুলোর সাধারণ মানুষ এই দুর্ভোগ থেকে বাঁচতে সিরাজগঞ্জ ছেড়ে টাঙ্গাইলের নাগরপুরের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। তবে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নাগরপুরকে বলছেন ‘না’।খাস ধলাই, যমুনার পশ্চিম পারে সিরাজগঞ্জের চৌহালীর একটি গ্রাম।
এই গ্রামে ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় খাস ধলাই আর আর কে দাখিল মাদরাসা। ২০০৮ সালে ওই মাদরাসাকে গিলে ফেলে যমুনা। পরে সেখান থেকে আধাকিলোমিটার পূর্ব দিকে সরিয়ে নেওয়া হয় মাদরাসা। দুই বছরের মাথায় সেখানেও মরণকামড় দেয় যমুনা। এরপর আরো তিন দফা ভাঙনে ক্ষতবিক্ষত মাদরাসাটিকে নিয়ে আসা হয় যমুনার পূর্ব পারে টাঙ্গাইলের নাগরপুরের সঙ্গে লাগোয়া সিরাজগঞ্জের চৌহালীর চরজাজুরিয়া গ্রামে।
ওই সময় যমুনাদ্রোহে শুধু খাস ধলাই আর আর কে দাখিল মাদরাসাই নয়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি দপ্তরও চলে আসে পূর্ব পারে।সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের যমুনা নদী ঘেঁষা চৌহালী উপজেলার উত্তরে টাঙ্গাইল সদর, পূর্বে নাগরপুর, দক্ষিণে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও পশ্চিমে বেলকুচি।
সিরাজগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে চৌহালী। দেড় লাখের বেশি মানুষের বাস এ উপজেলায়। প্রায় দুই যুগ আগে প্রথম যমুনা আঘাত হানে এ উপজেলায়। একদিক থেকে ভাঙতে থাকে পার। এভাবে ভাঙতে ভাঙতে কয়েক বছরের মধ্যে চৌহালীকে দুই ভাগ করে দেয় যমুনা। জামুরিয়া, খাস কাউলিয়া, খাস পুকুরিয়া, রেহাই পুকুরিয়া, বাগুটিয়া, চরসলিমাবাদ, বৈন্যা, কুর্কি, কোদালিয়া ও মিটুয়ানি গ্রামের ভাঙনকবলিত মানুষ পূর্ব দিকে চলে আসতে থাকে। একসময় টাঙ্গাইলের নাগরপুরের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।
নাগরপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে অনেকে জমি কিনে কেউ বা জমি ভাড়া করে আবার কেউ কেউ পূর্বপুরুষের ভিটায় বাস শুরু করে।যমুনার ভয়ে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরও পূর্ব পারে চলে আসে। প্রতিষ্ঠিত হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। উপজেলা পর্যায়ের অনেক কাজ এপারে হলেও মামলাসংক্রান্ত কাজ, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি ও ভর্তি পরীক্ষা এবং দাপ্তরিক বহু কাজের জন্য পূর্ব পারের লোকজনকে ছুটতে হয় সিরাজগঞ্জ সদরে। আর তখনই তাদের পাড়ি দিতে হয় যমুনা। যমুনা নদীর পূর্ব পারে বাস করা চৌহালীর কয়েক হাজার ভোটার রয়েছেন, যাঁদের ভোট দিতে পশ্চিম পারে যেতে হয়।
চৌহালীর খাস ধলাই গ্রামের আইয়ুব আলী জানান, ১৫ বছর আগে তিনি বাবার ওয়ারিশের প্রায় ৬০০ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন। ২০০৪ সালে হঠাত্ যমুনা ওই গ্রাম গ্রাস শুরু করে। পর পর চারবারের ভাঙনে সব সম্পদ হারিয়ে তিনি পরিবার নিয়ে ঠাঁই নেন টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার শাহজানী গ্রামে। সেখানে তাঁর দাদার রেখে যাওয়া জমিতে বাড়ি করেন। এখন তিনি নিজেই শ্রমিক হিসেবে কাজ করে সংসার চালান। খাস ধলাইসহ আশপাশের গ্রামের অসংখ্য মানুষের অবস্থাও তাঁর মতো।এদিকে চৌহালীর পূর্ব পারের মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে এরশাদ সরকারের আমলে তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসান উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাদের নাগরপুরের সঙ্গে একত্র করতে।
গ্রামের সাধারণ মানুষ এতে সাড়া দিলেও রাজনৈতিক নেতাসহ প্রভাবশালীরা প্রতিবাদ জানান। ফলে ওই উদ্যোগ তখনই ভেস্তে যায়।স্থানীয় ঘোরজান গ্রামের মোকাদ্দেস আলী, বাবর আলী ও ওমর আলী বলেন, যমুনার ভাঙনের শিকার হয়ে আমরা এপারে এসে বাড়িঘর করেছি। আমাদের নাগরপুর ও টাঙ্গাইলের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ আছে। চৌহালীর এপারের অংশ নাগরপুরের সঙ্গে যোগ হলে তো ভালোই হয়। সিরাজগঞ্জ যেতে সব সময় নৌকা পাওয়া যায় না। সমস্যা হয়।’
খাস কাউলিয়া গ্রামের আবু হানিফ মিয়া বলেন, ‘নাগরপুর আমাদের খুব কাছে। এখানে থাকতে পারলে সুবিধা হতো; কিন্তু নেতারা তা চান না। এপারে এলে তাদের নাম-ডাক থাকবে না।’ভিন্নমত ব্যক্ত করেন চৌহালী আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ হজরত আলী। তিনি জানান, প্রায় সাত কিলোমিটার পশ্চিমে যমুনার ওপারে মুরাদপুর গ্রামে ছিল তাঁর বাড়ি। ১৯৯৬ সালে প্রথম ভাঙে বাড়ি। সেখান থেকে চলে আসেন থানা সদর এলাকায়। ২০১৪ সালে সেটিও ভেঙে যায়। এরপর তিনি এপারে খাস কাউলিয়া পূর্ব জোতপাড়া গ্রামে বাড়ি করেন।
মুহাম্মদ হজরত আলী বলেন, ‘সিরাজগঞ্জের সঙ্গে নাগরপুর বা টাঙ্গাইলের কৃষ্টি কালচার, সামাজিক, রাজনৈতিক কোনো কিছুতেই মিলবে না। তাই চৌহালীর মানুষ যমুনার এপারে বাস করলেও তারা পারঘেঁষা নাগরপুরের সঙ্গে মিলতে চায় না। আমাদের জন্য নদী পাড়ি দেওয়া দুর্ভোগ নয়। তবে আফসোস বাপ-দাদার ভিটাতে আমরা থাকতে পারছি না।’
এ ব্যাপারে চৌহালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক সরকার বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ের সব কাজ এপারেই হয়। তবে জেলা পর্যায়ের কাজের জন্য ওপারে সিরাজগঞ্জ যেতে হয়। তখন পাড়ি দিতে হয় যমুনা। নদী পারাপার এখানকার মানুষের জন্য দুর্ভোগ নয়। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তা ছাড়া ওপারে যেতে এক ঘণ্টা পর পর নৌকা পাওয়া যায়।’