ফৌজদারি মামলার আসামিকে এখন থেকে সময় বেঁধে দিয়ে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিতে পারবেন না হাইকোর্ট। এমনকী আগাম জামিনের মামলায় আসামিকে গ্রেফতার বা হয়রানি না করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও এমন নির্দেশ দেওয়ার সুযোগ নেই আদালতের। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ রোববার (২৭ আগস্ট) এই নির্দেশনা দিয়েছেন।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই আদেশ এখন থেকে হাইকোর্টকে অনুসরণ করতে হবে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এএম আমিন উদ্দিন। তিনি বলেন, উচ্চ আদালত আসামিকে আগাম জামিন দেবেন, নয়ত আবেদন খারিজ করবেন। তবে সময় বেঁধে দিয়ে আসামিকে আত্মসমর্পণ বা গ্রেফতারের যে নির্দেশনা দিচ্ছেন সেটা এখন থেকে করার সুযোগ নাই।
শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের মামলায় হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করে আগাম জামিন চান সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকার। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ৮ আগস্ট আগাম জামিন না দিয়ে তাদেরকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে ঢাকার চিফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে ছয় সপ্তাহের মধ্যে তাদেরকে গ্রেফতার না করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন এই আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আবেদনের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এএম আমিন উদ্দিন বলেন, এই মামলায় হাইকোর্ট দুই আসামিকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু নির্দেশই নয় তাদেরকে গ্রেফতার না করতেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছে হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এই নির্দেশনা ‘রাষ্ট্র বনাম জাকারিয়া পিন্টু ও অন্যান্য’ মামলায় আপিল বিভাগের দেয়া রায়ের নির্দেশনার পরিপন্থী।
তিনি বলেন, আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, হয় আসামিকে আগাম জামিন দাও, নয়ত পুলিশের কাছে হস্তান্তর কর। কিন্তু এই নির্দেশনার বাইরে গিয়ে আসামিদের ছয় সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপিল বিভাগের ওই রায় এখনো বহাল আছে। চ্যালেঞ্জ হয়নি। সেজন্য ওই রায়ের আলোকে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে হাইকোর্টের আত্মসমর্পণের আদেশ বাতিল করা হোক।
সৈয়দ আশফাকুল দম্পতির পক্ষে অ্যাডভোকেট মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক গত ২১ আগস্ট তারা চিফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজিরা দিয়ে জামিন পেয়েছেন। হাইকোর্টের আদেশ কার্যকর হয়ে গেছে। এখন ওই আদেশ বাতিল করার সুযোগ কোথায়?
শুনানি শেষে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ হাইকোর্টের দেওয়া ছয় সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণ ও গ্রেফতার না করার আদেশ বাতিল করে দিয়েছেন। এছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের দেওয়া জামিন আদেশ বাতিল করে দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। বেঞ্চের অন্যান্য সদস্যরা হলেন, বিচারপতি বোরহানউদ্দিন, বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী।
এই মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেলকে সহায়তা করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, আপিল বিভাগের এই আদেশ নিম্ন আদালতে যাওয়ার পর দুই আসামি জামিন চাইতে পারবেন। ঢাকার চিফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আইন অনুসরণ করে জামিনের বিষয়টি নিষ্পত্তি করবেন।
প্রসঙ্গত ‘রাষ্ট্র বনাম জাকারিয়া পিন্টু ও অন্যান্য’ মামলায় আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, একজন পলাতক আসামি যদি হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করে সেক্ষেত্রে আদালত তাকে জামিন দিতে পারে। যদি জামিন না দেয় তাহলে আইন অনুসরণ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করবে। এছাড়া আসামিকে গ্রেফতার করতে পারবে না এমন নির্দেশ দেওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তব্যে বাধা দেওয়ার সামিল। যা তদন্তকেও বাধাগ্রস্ত করে। কারণ একজন অপরাধীকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা সামাজিক দায়িত্ব। আদালতের সিদ্ধান্তও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে না। বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০১০ সালে এ রায় দেন। রায়টি লিখেছিলেন ওই বেঞ্চের সদস্য বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক (পরবর্তীকালে প্রধান বিচারপতি)।