মাইনুল ইসলাম:
বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী ভাটা মালিকেরা হতাশা এবং আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছেন। সারাদেশের ইটভাটা মালিকেরা দুর্বিষহ বিভিন্ন প্রকার সমস্যা ও সংকটের মধ্যে আছেন এবং বাংলাদেশের প্রতিটা জেলার ইটভাটার মালিকেরা বিভিন্ন প্রকার সমস্যায় জর্জরিত। এভাবে তাদের ইটভাটা গুলো পরিচালনা করে আসছেন।
ঢাকা জেলায় গত বছরের চেয়ে এবার ইটভাটার সংখ্যা বেড়েছে, গত বছর ঢাকার কেরানীগঞ্জের ইট ভাটা গুলো প্রায় সবকটি বন্ধ ছিল। এ বছর পুনরায় আবার চালু করেছেন তবে সাভার, আশুলিয়া, ধামরাই, মানিকগঞ্জ সহ ঢাকার আশপাশ জেলাগুলোতো বেড়েছে বৈধ এবং অবৈধ ইটভাটা। তবে ইটভাটা মালিকেরা দাবি করছে, আমাদেরকে বৈধতা দেয় না কেন? আমরা যদি অবৈধ হবো তবে সরকার আমাদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা রাজস্ব অর্থাৎ ট্যাক্স ভ্যাট নিচ্ছেন। আবার বিভিন্ন সময় সরকারের প্রশাসনের লোকেরা অভিযান পরিচালনা করছেন এবং জরিমানাও করছেন। পাবনা জেলার আমিনপুর সুজানগর বেড়া, সাঁথিয়া, ভাঙ্গুরা ফরিদপুর ইটভাটা মালিকেরা বলেন, এবার আমাদের ইটভাটা মালিকদের মাথায় হাত আমাদের জেলাতে বেশিরভাগ ইটভাটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আর যেগুলো চলছে বিভিন্ন সমিতি থেকে ঋণ, মানুষের কাছ থেকে দাদন নিয়ে কোনরকম ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি। আবার অনেক মালিক ঋণের দায়ে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে। বেশিরভাগ মালিকেরা অভিযোগ করে বলেন,
ইট প্রস্তুত, ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে বর্ণিত জিগজ্যাগ ইটভাটার ছাড়পত্র ও লাইসেন্স প্রাপ্তি সহজতরকরণ এবং কয়লার দাম কমানো ও কয়লা সংকট নিরসনের দাবি জানিয়ে আসছি সরকার প্রধানের কাছে, আমরা এবং আমাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি। এ বিষয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
সারাদেশের তথ্য সংগ্রহ এবং আমাদের অনুসন্ধান মতে, নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার একজন ইটভাটা মালিক বলেন,২০২৪ ইং অর্থবছরে সারাদেশের ইট ভাটা মালিকদের কেউ লাভবান হতে পারবে না। কারণ কস্টিং খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ, আগে একজন লেবারের পিছনে খরচ হতো ৫০০ টাকা, এখন খরচ হয় ১০০০ টাকা, কয়লার দাম বৃদ্ধি মাটি সংকট,আমাদের মাটি ও কিনে আনতে হয়। তবুও মাটি পাওয়া যাচ্ছে না এবং মাটির দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ মাটি সরকার কাটতে দিচ্ছেন না, রাতের অন্ধকারে মাটি কাটতে ও আনতে হয়। বাংলাদেশের সব জেলাতেই ইটভাটার মাটির সংকট চরমে। আর মাটি ছাড়া ইট প্রস্তুত করা সম্ভব না। তিনি আরো বলেন,সরকার আমাদের মাটি ও কাটতে দিবে না এবং ছাড়পত্র ও দিচ্ছেন না।ভাটা চালাতে গেলে পরিপূর্ণ কাগজপত্র লাগে সে ক্ষেত্রে আমাদের বৈধ ঝিকঝাক ইট ভাটা যেগুলো আছে সেগুলোর ছাড়পত্র ও দিচ্ছেন না আবার সরকারি লোকজন এসে অভিযান চালিয়ে অর্থ দণ্ড করছেন। পাবনা জেলার আমিনপুরের একজন ইট ভাটা মালিক অভিযোগ করে বলেন, আমাদের পাবনা জেলার বেশিরভাগ ইটভাটায় খড়ি দিয়ে পোড়ানো হচ্ছে, খড়ি দিয়ে পোড়ানো তো সরকারিভাবে অবৈধ, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে করিনা, সর্ব প্রথম কয়লার দাম ছিল প্রতি টন পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার মধ্যে আর বর্তমানে তার দাম বেড়েছে তিনগুণ,লেবার কস্টিং বেড়েছে তিনগুণ বর্তমানে সব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম বেড়ে হয়েছে তিনগুণ। মোট কথা বর্তমান একটা ইট ভাটায় চার থেকে ৫ কোটি টাকা ইনভেস্ট করতে হয়। সে তুলনায় আমাদের ইটের দাম অনেক কম। কয়লা দিয়ে ইট পোড়ালে আমাদের যে কস্টিং হয় তাতে করে তুলনামূলক ভাবে ইট বিক্রি করতে পারিনা বরং আমাদের লোকসান হয়। এছাড়া সরকারি ঋণ ছাড়া এগুলো সম্ভব না আর আমরা এই ব্যবসা ছাড়তেও পারছি না এবং টিকে থাকতেও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে । কারণ মানুষের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে ইট ভাটায় ইনভেস্ট করতে হয়। তাছাড়া নানা প্রকার সমস্যার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হয়, যেমন লেবারদের লক্ষ লক্ষ টাকা দাদন দিয়ে আনতে হয়, আবার লেবাররা কয়েকদিন কাজ করার পরে গ্রুপ সহ রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়।আমাদের ভাই নানান সমস্যা ফেস করে এভাবেই ভাটা চালাতে হয়। আর এ বছর ইটের দাম কম,বেচাকেনা মোটেই নাই। লেবারদের খোরাকি দিতে পারি না। অনেক ভাটায় সিজন শেষ হওয়ার আগেই মাটির অভাবে ইট বানানো ও পোড়ানো বন্ধ করে দিয়েছেন। তাছাড়া বৈরী আবহাওয়ার ও বৃষ্টির কারণে লক্ষ লক্ষ ইট নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যে সকল মালিকেরা মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ইটভাটায় ইনভেস্ট করেছেন তারা এবার এত বড় লোকসান কাটিয়ে উঠতে না পারলে তাদের দেউলিয়া হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না। তিনি আরো বলেন, আমাদের প্রতিটি ইট ভাটায় ২০০ থেকে ৩০০ জন শ্রমিক কাজ করেন এবং এদের সাথে পরিবারবর্গ রয়েছেন। মোট কথা হাজারো লোকের এই ইটভাটা থেকে তাদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়। সরকার যদি এই ইট ভাটা গুলো বন্ধ করে দেয় শ্রমিক গুলো এবং মালিকেরা পথে ভিক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায়ান্তর থাকবে না। তাই আমাদের সরকার প্রধানের কাছে মালিক ও শ্রমিকরা জোর দাবি জানাচ্ছি ইট ভাটা শিল্প গুলো বন্ধ না করার জন্য।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি কেন্দ্রীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় সভায় সভাপতিত্ব করেন, সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি খলিলুর রহমান। সভাটি পরিচালনা করেন মহাসচিব আসাদুর রহমান খান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- সমিতির সহ-সভাপতি সাদরুল ইসলাম, ফিরোজ হায়দার খান, খালেকুজ্জামান, কাজী নাজির আহমেদ মুন্নু, যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক, নজরুল ইসলাম, খাজা নাসির উদ্দিন শান্তি, ফারুক আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক আমান উল্লাহ আমান ও কোষাধ্যক্ষ মোনায়েম খাঁন রাজা প্রমুখ।
উক্ত সভায় বক্তারা বলেন, ২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে জিগজ্যাগ ভাটা বৈধ পদ্ধতির উল্লেখ থাকলেও আইনের ৮ (৩) (ঙ) এবং ৮ (৩) (খ) উপধারায় দূরত্ব নির্দিষ্ট করার কারণে দেশের অধিকাংশ জিগজ্যাগ ইটভাটার মালিকরা ছাড়পত্র ও লাইসেন্স পাচ্ছেন না।
২০০২ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র এবং ২০১০ সালে পুনঃরায় অধিকতর পরিবেশবান্ধব জিগজ্যাগ ভাটা স্থাপনের নির্দেশে আমরা ভাটাগুলো স্থাপন করি। তারপরও আমাদের নানাভাবে হয়রানি হতে হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।
ইটভাটা মালিকরা তাদের বক্তব্যে বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ও ধারদেনা করে প্রতিটি ইটভাটায় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। প্রতিটি ভাটায় দুই থেকে তিনশ শ্রমিক কাজ করে। এখন এসব ভাটা বন্ধ করে দিলে মালিকদের পথে বসা ছাড়া উপায় থাকবে না। এছাড়া কয়লার সংকট ও দাম কমানোর এবং সকল প্রকার সমস্যা সমাধানেরও দাবি জানান তারা।