মানিকগঞ্জের সিংগাইরে বয়স্ক ভাতার টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের দপ্তরিসহ একটি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। বয়স্ক ভাতার নতুন কার্ডধারীদের মোবাইলের সিম থাকলেও একটি সিন্ডিকেট নতুন মোবাইল সিম নিতে নগদ একাউন্ট করতে বাধ্য করে। এমনকি নতুন সিমে একাউন্ট করে গোপন পিন গ্রাহককে না দিয়ে সেই সিম একটি সিন্ডিকেট আটকে রাখে। পরে বয়স্ক ভাতার প্রথম ধাপের ছয় হাজার টাকা উত্তোলন করে নিয়ে গ্রাহকদের সিম পৌঁছে দেয় চক্রটি।
অনেকের সিম পৌঁছে দিলেও গোপন পিন নম্বর দেয় পরে। এমন নেক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে উপজেলার জামির্ত্তা ইউনিয়নে। উপজেলা সমাজসেবা অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২১/২০২২ অর্থ বছরে সিংগাইর উপজেলার জামির্ত্তা ইউনিয়নে ২০০ জন ভাতাভোগী বয়স্ক ভাতার কার্ড পেয়েছেন। এ অর্থ বছরে প্রতিজন কার্ডধারীকে মোবাইল ব্যাংকিং নগদের মাধ্যমে ভাতার টাকা পরিশোধের কথা। ভাতার কার্ডধারীরা প্রথম ধাপে ৬ হাজার টাকা এবং দ্বিতীয় ধাপে ১ হাজার ৫০০ টাকা পাওয়ার কথা ছিল। একটি চক্রের খপ্পরে পরে অধিকাংশ গ্রাহকরাই প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের বয়স্ক ভাতার টাকা পাননি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ চক্রের মাস্টার মাইন্ড পরিকল্পনাকারি উপজেলার জামির্ত্তা ইউনিয়নের বিন্নাডাঙ্গী গ্রামের রিপন শিকদার । তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর আত্মীয় সমাজসেবা অধিদপ্তরের উচ্চ পদস্থ এক কর্মকর্তার সহায়তায় তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিজ ইউনিয়নে এ অনুদানটির বিল পাশ করিয়ে নেয় রিপন । এরপর তার সহযোগী একই গ্রামের বিনাডাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি আক্তার হোসেনকে নিয়ে উপজেলা সমাজসেবা অফিসের কারিগরি প্রশিক্ষক খোরশেদ আনসার খান বাচ্চুর সহায়তায় দরিদ্রদের ভাতার অধিকাংশ টাকাগুলো গায়েব করে দেয় এ চক্রটি ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অধিকাংশ বয়স্ক ভাতার কার্ডধারীকে নতুন করে মোবাইল সিমসহ নগদে একাউন্ট করায় এ চক্র। চক্রটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নগদ একাউন্ট খোলার পর গ্রাহকদের (ভাতাপ্রাপ্ত) কাছে মোবাইল সীম না দিয়ে তাদের কাছে রেখে দেয়। ওই মোবাইল নম্বরে বয়স্ক ভাতার প্রথম ধাপের ছয় হাজার টাকা আসার পর চক্রটি তা উত্তোলন করে। পরে ৩ থেকে সাড়ে ৩ মাস পর গ্রাহকদের কাছে মোবাইল সীমটি পৌঁছে দেয়।
এছাড়া অনেক কার্ডধারীকে নগদের গোপন পিন নম্বর দেয় তারও অনেক পরে। এতে অনেকের একাউন্টে দ্বিতীয় ধাপের এক হাজার ৫০০ টাকা আসলেও তারা তা উত্তোলন করতে পারছে কিংবা আবার আসলেও সিন্ডিকেট তা উত্তোলন করে নিয়েছে বলে জানা যায় ।
ভুক্তভোগী জামির্ত্তা ইউনিয়নের সুদক্ষিরা এলাকার মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, আমার মোবাইলে নগদ অ্যাকাউন্ট আছে। তারপরও বয়স্ক ভাতার জন্য নতুন করে মোবাইল সিমসহ নগদ একাউন্ট করায়। সিমের ফিংগার ও ২০০ টাকা দেয়ার প্রায় তিন মাস পর আমাকে মোবাইল সিম দেয়। এখন পর্যন্ত আমি এক টাকাও পাইনি। এমনকি নতুন নগদ একাউন্টের গোপন পিন নম্বরও দিয়েছে সিম দেয়ার এক মাস পর।
ডাউটিয়া এলাকার আকলিমা বলেন, আমার মাকে (ফুলজান) বয়স্ক ভাতার কার্ডে নাম দেওয়া হয়। যেদিন নাম দেই সেই দিন নতুন সিমের জন্য ফিঙ্গার নেওয়া হয়। সাথে রেজিস্ট্রেশনের জন্য ২০০ টাকাও নেয়। তিন মাস পর আমাদের মোবাইল সিম দেওয়া হয়। কিছুদিন পরে পিন দিলে এক হাজার ৫০০ টাকা একাউন্টে দেখি। দুইদিন পর তুলতে গেলে দেখি কে যেন তুলে নিয়েছে।
এমন অভিযোগ জামির্ত্তা ইউনিয়নের কহিলাতুলি এলাকার হাবেজা খাতুন, মমতাজ ও সুদক্ষিরা এলাকার মোঃ বাচ্চু মিয়ার মতো নতুন ২০০ ভাতাভোগী প্রায় সকলেরই ।
জামির্ত্তা ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী সদস্য শাহনাজ পারভীন ও সালমা আক্তার বলেন, মোবাইলের নতুন নগদ একাউন্ট করা ও ভাতার টাকা উত্তোলনের বিষয়ে আমরা কিছুই জানিনা। আমরা শুধু নামের তালিকা তৈরি করেছি। মোবাইল একাউন্টের জন্য ফিঙ্গার ও সিম বিতরণ করেছে রিপন শিকদার, আক্তার হোসেন ও খোরশেদ আনসার খান বাচ্চু।
অভিযুক্ত আক্তার হোসেন বলেন, রিপন শিকদারকে আমি নগদ মোবাইল ব্যাংকিং করার জন্য সহযোগিতা করেছি মাত্র । আমি এমনিতেই জনহিতকর কাজে আগ্রহী । গ্রাহকের টাকা কে নিয়েছে এ বিষয়ে আমার জানা নেই। আপনি রিপন সিকদারের সাথে কথা বলেন।
এদিকে রিপন শিকদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায় । বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি ।
জামির্ত্তা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন মোল্লা বলেন, উপজেলা সমাজসেবা অফিস হতে আমাকে জানানো হয় ২০০ জন বয়স্ক দরিদ্রদের তালিকা পাঠাতে তাদের ভাতা দেয়া হবে । অতপর সকল মেম্বারদের সাথে নিয়ে আলোচনা করে সবার মাঝে বন্টন করে ২০০ জন দরিদ্রদের তালিকা দেয়া হয় । তিনি আরও বলেন, ভাতাভোগীদের অনেকেই টাকা পাচ্ছেননা মর্মে তাকে অবহিত করলে তিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করেন বলে তিনি জানান । আবুল হোসেন বলেন, যারা দরিদ্রদের টাকা মেরেছে তাদের বিচার হওয়া দরকার ।
আরেক অভিযুক্ত সমাজসেবা অফিসের কারিগরি প্রশিক্ষক খোরশেদ আনসার খান বাচ্চু বলেন, এ বিষয়ে আমি এখন কোনো কথা বলতে পারব না। আপনি এক সপ্তাহ পর যোগাযোগ করেন। বয়স্ক ভাতার ওই কাজ নিয়ে আমি খুব ব্যস্ত আছি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার দিপন দেবনাথ বলেন, বয়স্ক ভাতার টাকা নিয়ে অনিয়মের বিষয়ে আমি শুনেছি। সমাজ সেবা অফিসের মাধ্যমে ৭ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।