ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে দেশের নয় জেলায় অন্তত ১৬ জনের মৃত্যুর পাওয়া গেছে। সোমবার (২৪ অক্টোবর) সন্ধ্যায় বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম শুরু করে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’। এর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই ঝড়ো হাওয়া আর ভারী বর্ষণ শুরু হয় উপকূলের জেলাগুলোতে।
মঙ্গলবার সকাল থেকে ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। ভোলায় চারজন, কুমিল্লায় তিনজন, গোপালগঞ্জের দুজন, সিরাজগঞ্জে দুজন, পটুয়াখালীতে একজন, বরগুনায় একজন, শরীয়তপুরে একজন, নড়াইলে এক নারী ও রাজধানীতে এক রিকশাচালকসহ ৯ জেলায় মোট ১৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর–
ভোলা
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে ভোলায় গাছ চাপায় ৩ ও জোয়ারের পানিতে ১ জনসহ ৪ জন নিহত হয়েছেন।মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) সকাল ৯ টার পর থেকে রোদের দেখা মিলছে ও আবহাওযা স্বাভাবিক হতে শুরু করলে আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়তে শুরু করেছে ভোলার মানুষ।
ভোলা জেলায় ঘর ও গাছ চাপায় নিহতরা হলেন- চরফ্যাশনের হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের মনির, দৌলতখানের পৌর ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বিবি খাদিজা ও ভোলা সদরের ধনিয়া ইউনিয়নের মফিজল হক। জোয়ারের পারনতে ডুবে মারা গেছে লালমোহন উপজেলার ফাতেমাবাদ গ্রামের রাবেয়া বেগম (২৫) ।
ভোলা শহরে মঙ্গলবার ভোর রাতে ৪ টায় বিদ্যুৎ এলেও মাঝে মাঝে লোডশেডিং হচ্ছে। এছাড়া ২৩ তারিখ থেকে পুরো জেলা বিদ্যুৎবিহীন। এখানকার মেবাইল টাওয়ারও কাজ করছে না। বিদ্যুৎ না থাকায় জেলার বেশিরভাগ মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। কেউ মঙ্গলবার জেনারেটরের দোকান থেকে ২০ টাকা করে দিয়ে মোবাইল চালু করছে।
অন্যদিকে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি বৃদ্ধি ও অতি বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতায় মাছের ঘের, পুকুর ডুবে মাছ বেড়িয়ে যায়, কৃষি জমি পানিতে তলিয়ে আছে। এদিকে বেড়িবাঁধের বাইরের বহু এলাকা এখনো জোয়ারে প্লাবিত হয়ে আছে। তুলাতলী এলাকার নেকু বিবি ও বিবি ফাতেমা বলেন, ঝড়ে আমাদের ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, আমরা অনেক কষ্টে আছি।
ধনিয়া তুলাতলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন আমিরুন নেছা (৭৫), আছিয়া বেগম (৩৫) ও কুলসুম (২৯)। তারা বলেন, আমরা রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম, এখন চলে যাচ্ছি। আবহাওয়া অনেকটা ভালোর দিকে। তাই পরিবার নিয়ে চলে যাচ্ছি।
জেলা প্রশাসক তৌফিক-ই-লাহী চৌধুরী বলেন ঝড়ে বিভিন্ন বিভাগের ক্ষতির নিরূপণের কাজ চলছে। এবং ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের তালিকা করছে উপজেলা প্রশাসন। তালিকা পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কুমিল্লা
ঝড়ের মধ্যে রাত ১১টার দিকে নাঙ্গলকোট উপজেলার হেসাখাল ইউনিয়নের হেসাখাল পশ্চিম পাড়ায় গাছ ভেঙে ঘরের উপর পড়ে ৩ জনের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন- হেসাখাল পশ্চিম পাড়া গ্রামের নিজাম উদ্দিন, তার স্ত্রী শারমিন আক্তার সাথী এবং তাদের মেয়ে চার বছরের শিশু নুসরাত আক্তার লিজা।
নাঙ্গলকোট থানার ওসি ফারুক হোসেন বলেন, ঘরের ওপর পড়া গাছটি সরানোর চেষ্টা করছেন তারা। ওই তিনজন ছাড়া আরও কেউ চাপা পড়েছে কি-না, তা খুঁজে দেখা হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ
ঝড়ের সময় সিরাজগঞ্জ সদরে যমুনা নদীর একটি খালে নৌকা ডুবে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের পূর্বমোহন ও শিল্পপার্কের মাঝামাঝি এলাকার খালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। বৈঠাচালিত নৌকাটি শিল্পপার্ক থেকে পূর্বমোহনপুরে যাচ্ছিল।
মৃত দুজন হলেন– উপজেলার পূর্বমোহনপুর গ্রামের খোকনের স্ত্রী আয়েশা খাতুন (২৮) এবং তার ছেলে আরাফাত হোসেন (২)।
বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ওসি মোসাদ্দেক হোসেন জানান, ওই নৌকায় চড়ে মোট ছয়জন পূর্বমোহনপুরে তাদের বাড়িতে ফিরছিলেন। মাঝপথে ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে নৌকাটি ডুবে যায়।
গোপালগঞ্জ
রাতে ঝড়ের মধ্যে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাঁচ কাহনীয়া ও বাঁশবাড়িয়া গ্রামে গাছ চাপা পড়ে দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন–পাঁচ কাহনীয়া গ্রামের রেজাউল খার স্ত্রী শারমিন বেগম (২৫) এবং বাঁশবাড়িয়া গ্রামের হান্নান তালুকদারের স্ত্রী রুমিছা বেগম (৬৫)।
টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি আবুল মনসুর বলেন, ঝড়ের সময় শারমিন বেগম ঘরের বারান্দায় বসে কাজ করছিলেন। হঠাৎ একটি গাছ ভেঙে ঘরের বারান্দায় পড়ে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
পটুয়াখালী
পটুয়াখালীতে ঝড়ের মধ্যে নোঙ্গর করা ইটভর্তি একটি ট্রলার ডুবে নিখোঁজ এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল।
নিহত নূর ইসলাম (৪০) সদর উপজেলার লোহালিয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরপুর গ্রামের রশিদ মোল্লার ছেলে।
সোমবার রাত ৮টার দিকে প্রতাপপুর লঞ্চঘাটে নোঙ্গর করা অবস্থায় ঢেউয়ের তোড়ে ট্রলারটি লোহালিয়া নদীতে ডুবে যায়। ট্রলারের মালিক জলিল মোল্লা সাঁতরে তীরে ফিরতে সক্ষম হলেও নূর ইসলাম ডুবে যান।
পটুয়াখালীর একটি ইট ভাটা থেকে ২৫ হাজার ইট নিয়ে মুরাদিয়া যাচ্ছিলেন ট্রালার মালিক জলিল মোল্লা। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে তিনি লঞ্চঘাটে ট্রলার নোঙ্গর করেছিলেন।
নড়াইল
ঘূর্ণিঝড় উপকূলে পৌঁছানোর আগেই দুপুরে ঝড়ো হাওয়ায় গাছের ডাল ভেঙে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার দুপুরে উপজেলা পরিষদ চত্বরে এ ঘটনা ঘটে বলে লোহাগড়া থানার ওসি মো. নাসির উদ্দীন জানান।
নিহত মর্জিনা বেগম (৪০) বাগেরহাট সদর উপজেলার অর্জনবাহার গ্রামের বাসিন্দা। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ১১ বছরের ছেলেকে নিয়ে তিনি লোহাগড়া পৌর এলাকার রাজপুর গ্রামের আবদুল গফ্ফারের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন বিভিন্ন বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন তিনি।
লোহাগড়া উপজেলার ইউএনও মো. আজগর আলী বলেন, বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে। নিহতের পরিবারকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।
বরগুনা
বরগুনা সদর উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে গাছের নিচে চাপা পড়ে শতবর্ষী এক বৃদ্ধার প্রাণ গেছে।
ইউএনও কাওসার হোসেন বলেন, আমরা আমেনা খাতুনের বাড়ি গিয়ে বিস্তারিত জেনেছি। তার দাফনসহ সার্বিক সহযোগিতা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হবে।
শরীয়তপুর
শরীয়তপুরের জাজিরায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে গাছ চাপায় ৬৫ বছর বয়সী এক নারী মারা গেছেন। সোমবার রাত ৮টার দিকে ঘুর্ণিঝড়ের তীব্র বাতাসে গাছ উপড়ে তার বসত ঘড়ের উপর আছড়ে পড়লে গাছ চাপায় মারা যান তিনি।
নিহত সুফিয়া জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর ইউনিয়নের সিডারচর গ্ৰামের হালান মুসুল্লীর স্ত্রী। জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান সোহেল এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ঢাকা
সিত্রাংয়ের প্রভাবে বৃষ্টি আর ঝড়ের মধ্যে ঢাকার হাজারীবাগে দেয়াল ধসে এক রিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় জিগাতলার মনেশ্বর রোডে এ ঘটনায় আহত হয়েছেন এক মোটর সাইকেল চালক।
হাজারীবাগ থানার ওসি এনামুল হক খন্দকার বলেন, ঘটনার সময় বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। নিহত ব্যক্তি রিকশা নিয়ে যাচ্ছিলেন। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন বাইক আরোহী। তখন চারতলা একটি ভবনের ছাদের রেলিং ধসে পড়ে।