ময়মনসিংহ (মোমেনসিং) ও জফরশাহীর পরগনার জমিদার শ্রীকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর দুই পুত্র দত্তক নিয়েছিলেন মাধবি তথা আলেয়ার গর্ভজাত সিরাজ পুত্রকে। নবাব সিরাজের পুত্রের নয়া নামকরণ হয় যুগলকিশোর রায় চৌধুরী। এভাবেই নতুন করে যাত্রা শুরু করে নবাব সিরাজ উদ দৌলার বংশ। যা অনেকের অচেনা ছিল।
তখন ইংরেজরা জানতে পারলে কখনও সিরাজের পুত্রকে বাঁচিয়ে রাখতো না, তা সত্য। ফরিদপুর জেলার যাপুর গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবারের রুদ্রাণী দেবীকে বিয়ে করেছিলেন যুগলকিশোর রায় চৌধুরী। তাঁর প্রথম স্ত্রী রুদ্রাণী দেবীর গর্ভেই হরকিশোর এবং শিবকিশোর নামের দুই পুত্রের জন্ম হয়। একইসঙ্গে জন্ম নেয় আরও চার কন্যা। অন্নদা, বরদা, মোক্ষদা এবং মুক্তিদা। পুত্র শিবকিশোর অল্প বয়সেই মারা যান।
হরকিশোর রাজশাহী জেলার বৃকুৎসা গ্রামের কাশীনাথ মজুমদারের মেয়ে ভাগীরথী দেবীকে বিয়ে করেন। তাঁর গর্ভে কৃষ্ণমণি নামে এক কন্যার জন্ম হয়। কৃষ্ণমণির শৈশবকালেই পিতা হরকিশোরের মৃত্যু হয়। ময়মনসিংহের গৌরীপুরে কৃষ্ণমনি ছিলেন নবাব সিরাজের শেষ বংশধর।
‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ ইতিহাস বইয়ের লেখক জমিদার শ্রী শোরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী গৌরীপুরের জমিদারদের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। তার লেখা ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ প্রথম খণ্ড থেকে জানা গেল যে, ভাগীরথী দেবীর স্বামীর আদেশানুসারে গৌরীপুর শহরের কাছে গোলকপুর এস্টেটের জমিদার সম্ভু চন্দ্র চৌধুরীর পুত্র ঈশ্বর চন্দ্র চৌধুরীকে দত্তকরূপে গ্রহণ করেন। ওই গৃহীত দত্তক পুত্র আনন্দকিশোর রায় চৌধুরী নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীতে দত্তক পুত্র আনন্দকিশোরের উচ্ছৃঙ্খলতা ও অপব্যয় স্পৃহা দেখে ভাগীরথী দেবী খুব মর্মাহত হলেন।
আনন্দকিশোর প্রাপ্ত বয়ষ্ক হয়ে জমিদারির দাবী করলে ভাগীরথী দেবী এরূপ দত্তক পুত্রের হাতে জমিদারির ভার অর্পণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। ফলে পারিবারিক কলহ অনিবার্য হয়ে উঠল। সমস্ত সম্পত্তি সমান দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একাংশ ভাগীরথী দেবীর হাতে রইল ও অপরাংশ আনন্দকিশোরের।
ভাগীরথী তার একমাত্র কন্যা কৃষ্ণমনির অবস্থার উন্নতিকল্পে সর্বদাই ব্যস্ত থাকতেন এবং আনন্দকিশোর তা দেখে সহ্য হতো না। ভাগীরথীর একমাত্র কন্যা কৃষ্ণমনি খাজুরা নিবাসী গোবিন্দপ্রসাদ লাহিড়ি নামক এক কুলীন বালকের সহিত বিবাহকার্য সম্পন্ন করেন। এই বিবাহকার্য অতীব সমারোহের সহিত সম্পন্ন হলো। বিবাহের যৌতুক স্বরূপ এক বৃহৎ তালুক প্রদত্ত হলো। গৌরীপুর এস্টেট, কালীপুর এস্টেট ও গোলকপুর এস্টেট এর সন্নিকটে কন্যা-জামাতার জন্য বাসভবন নির্মাণ হলো। কৃষ্ণমনির নামানুসারে নতুন বাড়ির জায়গার নাম দেওয়া হয় কৃষ্ণপুর।
এভাবে নবাব সিরাজের পুত্র যুগলকিশোর রায় চৌধুরীর একটা অংশ কৃষ্ণপুর জমিদারি হিসেবে পরিগণিত হয়। তার আরেকটি অংশ গৌরীপুর এস্টেট। কৃষ্ণপুর এস্টেট হিসেবে গোড়াপত্তন হওয়ার পর কৃষ্ণপুর বিশেষ সমৃদ্ধি সম্পন্ন হলো।
কৃষ্ণমনির বিবাহের অল্পদিনের মধ্যে তার স্বামীর মৃত্যু হয়। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন বিধায় বিক্রমপুরের নবকুমার স্যানেলের পুত্র কৃষ্ণপ্রসাদকে দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। কৃষ্ণপ্রসাদ প্রাপ্ত বয়ষ্ক হয়ে জমিদারির কার্য শুরু করেন। কৃষ্ণপ্রসাদ লাহিড়ি ঢাকা জেলার কেওয়ান গ্রামের মেয়ে স্বর্ণময়ী দেবীকে বিয়ে করেন।
তাঁর গর্ভে সিন্ধুবালা, গিরিবালা ও ব্রজগোপী নামে তিন কন্যার জন্ম হয়। কয়েক বছরের মধ্যে স্বামীর মৃত্যুর পর স্বর্ণময়ী দেবীই জমিদারির ভারপ্রাপ্ত হন। তিনি প্রতিকূলের জলপিন্ড ও জমিদারি রক্ষার জন্য বালিহার গ্রাম নিবাসী যোগেন্দ্র চন্দ্র লাহিড়ির পুত্র সুরেন্দ্রপ্রসাদ লাহিড়িকে পুত্ররূপে গ্রহণ করেন।
স্বর্ণময়ী দেবী অতি দক্ষতার সহিত জমিদারি কার্য পরিচালনা করে বিশেষ যশঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি কালীপুরের অন্যতম জমিদার অবনীকান্ত লাহিড়ি চৌধুরীর জমিদারির অংশ ক্রয় করেছেন। তাছাও তিনি অন্যান্য জেলায় দুই একটি জমিদারির অংশ ক্রয় করেছেন।
১৩১৫ সালে নিজ প্রাসাদে (বর্তমান গৌরীপুর সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস) রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। সুরেন্দ্রপ্রসাদ লাহিড়ি জমিদারি ভার গ্রহণ করার পর তিনি মুক্তাগাছার রাজা জগৎকিশোর আচার্য চৌধুরীর কন্যা সরযুবালা দেবীকে বিবাহ করেন (সুরেন্দ্রপ্রসাদ লাহিড়ির স্ত্রীর নামানুসারে বর্তমান গৌরীপুর শহরে সরযুবালা প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে)।
কৃষ্ণপুরের কৃষ্ণমনি দেবী অতি পুণ্যশীলা রমণী ছিলেন। তিনি ১২১৬ সনের আষার মাসে জন্মগ্রহণ করে ১৩১৫ সালের (১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে) ১৯ বৈশাখ মৃত্যুবরণ করেন।
কৃষ্ণমনির প্রায় একশ বছরের সুদীর্ঘ আয়ু অতি অল্প লোকেরই দেখা যায়। গৌরীপুরে কৃষ্ণপুর এস্টেটের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে রয়েছে গৌরীপুর সরকারি কলেজ, রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ মন্দির, কলেজের পিছনে চিকন ইটের প্রাচীন ওয়াল বা বাউন্ডারি। তা ছাড়াও গৌরীপুর উপজেলার বেকারকান্দা গ্রামের নিবাসী মোসলেহ উদ্দিনের বাড়িতে কৃষ্ণপুর এস্টেট কর্তৃক কৃষ্ণপুর জমিদারের এক মুসলিম কর্মচারীর পাকা কবর ও একটি ইন্দারা রয়েছে।