আজ ৩ ডিসেম্বর। মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে মুক্তিপাগল বাঙালি। লাগাতার গেরিলা হামলা ও ভয়ংকর সম্মুখ যুদ্ধে দিশেহারা পাক হানাদার বাহিনীর। ফলে রণাঙ্গণে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ফলে আরও গতি পায় মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র দেওয়ার অভিযোগ তুলে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতের ওপর হামলা চালায়। তার পরিপেক্ষিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক ভাষণে বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব আক্রমণের দায় পাকিস্তানের। যুদ্ধ মোকাবিলায় দেশকে তৈরি করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।
দেশের ৭টি সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে ভারতীয় বাহিনী। এবার একইসঙ্গে গেরিলা হামলা এবং সম্মুখ সমরে নামে যৌথ বাহিনী। বীর সন্তানদের উপর্যুপরি গেরিলা আক্রমণ ও সম্মুখ যুদ্ধে পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। বিভিন্ন এলাকায় পরাজিত হয়ে পালিয়ে ঢাকার দিকে যেতে থাকে তারা।
এ দিনে এক অভূতপূর্ব অধ্যায়ের সূচনা করে। বাংলাদেশে ভারতীয় বিমান ও বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর একদল চৌকস মুক্তিযোদ্ধা মধ্যরাতে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে গিয়ে পাক বাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানের ওপর বোমা বর্ষণ করে। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাক বাহিনীর ঘাঁটি।
এসব ঘাঁটিতে হামলার প্রধান কারণ ছিল হানাদারদের আকাশ যুদ্ধের সক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে আকাশে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা। আর এ অপারেশনে ব্যাপক সাফল্য পায় যৌথ বাহিনী।
৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে একটি অটার বিমান নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম (স্বাধীনতার পর দু’জনই সাহসিকতার জন্য বীরউত্তম খেতাব পান) দু’জন গানার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল জ্বালানি সংরক্ষণাগারে একের পর এক রকেট নিক্ষেপ করে সম্পূর্ণ সেটি ভস্মীভূত করে দেন।
অন্যদিকে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম (স্বাধীনতার পর এই দু’জনও সাহসিকতার জন্য বীরউত্তম খেতাব পান) আরেকটি ‘অ্যালুয়েট’ যুদ্ধ বিমান নিয়ে চট্টগ্রামের জ্বালানি সংরক্ষণাগারে উপর্যুপরি বোমা বর্ষণ করে সেটি ধ্বংস করে দেন।
জ্বালানির দুটি প্রধান উৎস ধ্বংস হয়ে গেলে মনোবলে চিড় ধরে দখলদারদের। কেননা জ্বালানির অভাবে হানাদারদের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হয়। এতে যুদ্ধ ক্ষমতা প্রায় শেষ হয়ে চরম বিপাকে পড়ে তারা।
অপরদিকে আক্রমণের প্রথমেই উপকূলবর্তী বন্দরগুলো অবরোধ করে হানাদার বাহিনীর সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করা হয় এবং পাক সাবমেরিন গাজীকে বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেয় বাংলাদেশ নৌ বাহিনী।
এ দিনে যৌথ বাহিনীর স্থল, আকাশ ও নৌপথে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, জেলার আরও কয়েকটি থানা মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রণে নেয়। মুক্ত হয় ঠাকুরগাঁও ও বরগুনা।
এভাবে ৩ ডিসেম্বরের একের পর এক সফল অপারেশন পাক হানাদারদের নিশ্চিত পরাজয়ের দিকে ধাবিত করে।
এদিকে একই দিনে আমেরিকান সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি রাওয়ালপিন্ডিতে সাংবাদিকদের জানান, তিনি অনেকবার চেষ্টা করার পরও শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। এতে ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে পাকিস্তান।
৩ ডিসেম্বর থেকেই পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যকার পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলান্সের সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়। ঢাকায় কারফিউ ও ব্ল্যাকআউট জারি করে হানাদারেরা।